মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চুক্তি নিয়োগ রাজত্বে শীর্ষ কর্মকর্তারা

♦ মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্রসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা চুক্তিতে ♦ আইজিপি, র‌্যাবের ডিজিসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও আছেন ♦ আট মাসে চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন ৭৫ জনের বেশি ♦ রাষ্ট্র উপকৃত হবে তাদেরই রাখা হচ্ছে : প্রতিমন্ত্রী

ওয়াজেদ হীরা

প্রশাসনের শীর্ষ পদ সচিবদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে। সচিব ছাড়াও জনপ্রশাসনের বেতন কাঠামোর শীর্ষ স্তর গ্রেড-১ পদ ও অতিরিক্ত সচিব পদেও এখন চুক্তি নিয়োগ চলছে। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা বঞ্চিত হচ্ছেন। শীর্ষ পদে যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে বঞ্চিতদের বাড়ছে কষ্ট। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চুক্তিতে নিয়োগের কারণে অনেক কর্মকর্তা কাক্সিক্ষত পদ না পেয়ে অবসরে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনের বছরে শুরু থেকেই এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে। প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বা সংস্থার দায়িত্বে এখন চুক্তিভিত্তিক হিসেবে কাজ করছেন অন্তত ১৮ কর্মকর্তা। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বাহিনীর প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিভিত্তিক। এতে একদিকে সরকারের ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে নিচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সচিবালয়ে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক আলোচনায় আছে এই চুক্তির নিয়োগ। অনেকে মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও অনেক কর্মকর্তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। সচিব ছাড়াও জনপ্রশাসনের বেতন কাঠামোর শীর্ষ স্তর গ্রেড-১ পদ ও অতিরিক্ত সচিব পদেও কর্মকর্তারা চুক্তিতে দায়িত্ব পেয়েছেন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চুক্তি নিয়োগ একেবারেই জরুরি নয়। যেখানে স্থান পূরণ করার মতো লোক আছে সেখানে মোটেই জরুরি নয়, এটা অনাবশ্যক। তিনি বলেন, চুক্তি নিয়োগের বিধানটা রাখা হয়েছে, যদি ওই ধরনের লোক না থাকে বা পাওয়া দুষ্কর হয় তার নিয়োগের জন্য। যেখানে একজন সচিব অবসর নিলে ১০ জন অতিরিক্ত সচিব বসে আছে অথচ ওই সচিবকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া অসংগত।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৮১ জন। মাঝের কয়েক বছর জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমে এসেছিল। বিশেষ করে নিয়মিত পদগুলোতে চুক্তিতে কম নিয়োগ দেওয়া হতো। চুক্তিতে এক কর্মকর্তাকে রেখে দেওয়া মানে তার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ বাড়তি ব্যয় করতে হয় সরকারকে। শুধু বেতন দিতেই সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় মাসে ৫০ লাখ টাকার বেশি। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যয় তো আছেই। জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় যোগ্যতা আসলে সরকারের ঘনিষ্ঠ থাকা। সরকার প্রয়োজন মনে করলে একজন কর্মকর্তাকে চুক্তিতে রাখে। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক তদবির বা সিনিয়রদের দিয়ে, ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন দিয়ে অনুরোধ করিয়ে চুক্তি নিয়োগ পাওয়ার হিড়িক বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট এই আট মাসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, সিনিয়র সচিব, সচিব বা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসসহ বিভিন্ন দফতরে ৭৫ জনের বেশি কর্মকর্তা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। সর্বশেষ ৩১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে সংযুক্ত সচিব মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খানকে এবং সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুজ্জামানকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, দেশের স্বার্থে, কাজের স্বার্থে, প্রকল্পের চলমান কাজ এগিয়ে নিতে কাউকে কাউকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সামনে নির্বাচন, এখন যারা অবসরে যাচ্ছেন দুই-তিন মাসের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, একটা প্রতিষ্ঠানের উইং কতগুলো এসব বুঝতেই দুই মাস লেগে যায়। এতে কাজে ব্যত্যয় হতে পারে। যাদের চুক্তিতে নিয়োগ দিলে রাষ্ট্র উপকৃত হবে, তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। চুক্তি নিয়োগে আমরা দেখি তার দক্ষতা এবং যোগ্যতা এবং তিনি খুব ভালো করছেন কি না। অপ্রয়োজনীয় কাউকে চুক্তিতে রাখা হয় না বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।

এ বছরই চুক্তিতে এক বছরের নিয়োগ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এ ছাড়াও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিপিসির চেয়ারম্যান (সচিব পদপর্যাদা), রাজউক চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা), গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক সি. সচিব মো. আখতার হোসেন, রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে সচিব (সংযুক্ত) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান। আর আগে থেকেই চুক্তিতে দায়িত্ব পালন করে আসছেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

শুধু প্রশাসনেই নয়, পুলিশেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে পুলিশের আইজিপি ও র‌্যাবের মহাপরিচালকও এখন চুক্তিতে কর্মরত। বিদেশের দূতাবাসগুলোর মধ্যে জার্মানি, ইরাক, কানাডা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে এ বছরই চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিনিয়র সচিব ও সচিব ছাড়াও বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে বা দফতরে উচ্চতর পদে এ বছরই চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন কমপক্ষে ৫০ কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর