বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিকল্প বাণিজ্যের পরিকল্পনা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম পোশাকের বাজার রাশিয়া। আনুমানিক ২৩ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাকের বাজার রয়েছে দেশটিতে; যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। রাশিয়ার মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ১১ দেশের জোট কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস-সিআইএসের বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। প্রায় ১৪ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি বাজার রয়েছে সিআইএস জোটে। সুযোগ রয়েছে আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান নিয়ে রাশিয়া নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নেও রপ্তানি সম্প্রসারণের। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের ঢাকা সফরে সেই সুবিধা নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে।

সূত্রগুলো জানাচ্ছেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দিনের সফরে ঢাকা আসছেন আজ। তাঁর সম্মানে রাজধানীর একটি হোটেলে রাতে ওয়ার্কিং ডিনারের আয়োজন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওয়ার্কিং ডিনারে নিমন্ত্রণের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপনকান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের আগে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রাশিয়ায় আমাদের পণ্য রপ্তানি হতো। এখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানি-রপ্তানি দুটোই বন্ধ আছে। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বিকল্প পথে বাণিজ্য বাড়ানোর প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বড় দেশ হিসেবে রাশিয়ায় বাংলাদেশের যে পরিমাণ বাণিজ্য হওয়ার কথা, প্রকৃত অর্থে কখনোই তা হয়নি। কারণ দেশটির সঙ্গে সরাসরি ব্যাংকিং লেনদেন চালু না থাকায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এলসি খুলে পণ্য রপ্তানির সুযোগ পেতেন না। তৃতীয় দেশের মাধ্যমে প্রতি বছর কিছু পণ্য রপ্তানি হতো দেশটিতে। বাণিজ্য বাড়াতে এর আগে বেশ কয়েকবার দেশটির সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আলোচনা হয় রুশ নেতৃত্বাধীন সিআইএসের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিতে। তবে সেই আলোচনাও বেশি দূর এগোয়নি। তখন রুশ বাণিজ্য ছিল ইউরোপমুখী। এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও বড় দেশ হিসেবে চীন, ভারত ও তুরস্কের সঙ্গে ছিল দেশটির বাণিজ্য। ফলে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলেও দেশটিতে বাণিজ্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া মাঝপথে থমকে গেছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর পরিস্থিতি বদলে গেছে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া বরং বাংলাদেশের সঙ্গে কীভাবে বাণিজ্য বাড়ানো যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ জোরদার করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা এখন এশিয়ার দেশগুলোয় নতুন বাজার অনুসন্ধান করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে ক্রুড জ্বালানি রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুসারে স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য রপ্তানির জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছে দেশটি। জানা গেছে, গত জুনে রাশিয়ার রাষ্ট্রমালিকানাধীন জেএসসি এফইসি প্রোদিনতর্গের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে নিত্যপণ্য রপ্তানির আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত রুশ দূতাবাস এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির আগ্রহের বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। ওই চিঠিতে জিটুজি ভিত্তিতে হলুদ মটর, ছোলা, লাল ও সবুজ মসুর ডাল, সূর্যমুখী তেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করে মস্কো। এ প্রস্তাব নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবটি পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সূত্রগুলো বলছেন, রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তৃতীয় কোনো দেশের মুদ্রায় যাতে বাণিজ্য করা যায় সে বিষয়েও আগ্রহ দেখাচ্ছে রুশ কর্তৃপক্ষ। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতি, বার্টার ট্রেড, ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহারসহ বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। এমনকি চীনের মুদ্রায় লেনদেনের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লেনদেনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকও করেছেন মস্কোর কর্মকর্তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির বদল হয়েছে। একসময় বাংলাদেশ রাশিয়ায় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এখন রাশিয়া বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পুরো বিষয়টিই এখন এগিয়ে যাবে দরকষাকষির মধ্য দিয়ে। মস্কো যদি বাংলাদেশে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য রপ্তানির সুযোগ চায়, তবে বাংলাদেশও রাশিয়া নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নে রপ্তানি সম্প্রসারণের সুযোগ চাইবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বিকল্প পথে কীভাবে সেই বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যাবে, এটিই এখন আলোচনার বিষয়।

সর্বশেষ খবর