শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
ভোটের আগে বিচার শুরু নিয়ে আতঙ্ক বিএনপি নেতা-কর্মীদের

গায়েবি মামলায় উৎকণ্ঠা

শফিউল আলম দোলন

গায়েবি মামলায় উৎকণ্ঠা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মতো বাকি। ভোটের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে নামে-বেনামে মামলা ও গায়েবি মামলা নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে-বেনামে থাকা সব মামলার বিচার শুরু হয়েছে। অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে চলছে এসব মামলার কার্যক্রম। চলছে সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ। অনেক মামলাই এখন শুধু রায়ের অপেক্ষায়। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবার দিনের শুরু হয় আদালতপাড়ায়। বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধেই রয়েছে শতাধিক মামলা।

বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা ৩৭টি মামলা ছাড়াও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়েছে ৯৩টি। এর মধ্যে তার নামে দায়ের করা ভোর রাতে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুর মামলার ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আর সর্বোচ্চ ৪৫১টি মামলা করা হয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দেওয়া ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪টি মামলায় ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৮ ও ২৯ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিসহ এর পরের কয়েকটি কর্মসূচি ঘিরে এক মাসে সারা দেশে ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজার ৭২০ জনকে। গ্রেফতার হয়েছেন ১ হাজার ৭৫০ জন।

মামলার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার বিরোধী দলমত দমনে মরণ কামড় দিতে চাচ্ছে। অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা ও গায়েবি মামলার রায় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে হয়তো আমাকেও সাজা দিয়ে জেলে পাঠাতে পারে। কয়েকদিন আগে আমার মামলায়ও ট্রায়াল শুরু হয়েছে।’ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অভিযোগ, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে এবং একতরফা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সরকার বরাবরের মতো এবারও মামলা-হামলাকেই বেছে নিয়েছে। রাজপথের শক্ত আন্দোলন দমন করতেই এ উদ্যোগ। দলের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে বেশি করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আবার পুরনো মামলাগুলোকেও সক্রিয় করা হয়েছে। অনেক মামলার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে আনা হয়েছে। এ ছাড়া কারও মামলা শুনানি শেষ পর্যায়ে, আবার কারও সবেমাত্র শুরু হয়েছে। কেউ আসছেন জামিন নিতে, আবার কেউ হাজিরা দিতে। আবার কাউকে জামিন নামঞ্জুর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারাগারে। এভাবেই দিনের পুরোটা সময় আদালত অঙ্গনে কাটাতে হচ্ছে তাদের। ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার-পরিজন ফেলে রেখে মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী। অনেকেই রয়েছেন কারান্তরিন। ভোটের আগে বিএনপি নেতাদের মামলার দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ সরকার প্রতিহিংসার পথে আদালতকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিরোধী নেতাদের গায়েবি মামলায় সাজা দেওয়ার হিড়িক শুরু করেছে। অবৈধ সরকার নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গণতন্ত্রকামী বিরোধী দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছেন, তারাই এ সরকারের আজ্ঞাবহ আদালতের কোপানলে সাজা ও কারাবন্দির শিকার হচ্ছেন। আইন, বিচার, আদালত, প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোর ওপর সর্বগ্রাসী আক্রমণ চালাচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রতিদিনই মামলার সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশে সক্রিয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের মহোৎসব চলছে। গায়েবি মামালা দায়ের, দ্রুত মামলার রায় দেওয়া, এসব হচ্ছে আওয়ামী লীগের পুরনো খেলা। সংশ্লিষ্ট অপর এক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৬টি। স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে সাতটি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে চারটি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ছয়টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ছয়টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে নয়টি, বেগম সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে চারটি ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অঙ্গসংগঠনের ভিতরে সর্বোচ্চ মামলার খড়গধারী নেতাদের মধ্যে- যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৩১৩টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব ৩০৫টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ২৫৪টি, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ২০৪টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ১৮০টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির বিরুদ্ধে ১৮৪টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে ১৪৭টি, যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসাহাক সরকারের বিরুদ্ধে ৩২৭টি মামলা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১০৬টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ১০৩টি মামলা রয়েছে। আরও অনেক নেতার নামে মামলার সংখ্যা সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি পার হয়েছে অনেক আগেই। এখনো সারা দেশে প্রতিদিনই গায়েবি মামলা যোগ হচ্ছে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে হাজার হাজার মামলা। যেসব মামলায় আসামি রয়েছেন লাখ লাখ নেতা-কর্মী। তবে রাজধানী ঢাকার নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন সংখ্যার দিক থেকে। এখানে ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলায় আসামি ২ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৫ জন।

যেসব মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে : বর্তমানে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার থেকে শুরু করে ২০১৩ থেকে ১৫ সালে করা মামলার কার্যক্রম সবচেয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে বেশকিছু মামলা শেষ পর্যায়ে। রাজনৈতিক এসব মামলায় বিএনপি মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, দলের মাঝারি পর্যায়ের ও তৃণমূলের অনেক নেতাই আসামি। ওই সময়ের একটি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৯ বছর কারাদণ্ড, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছরের কারাদণ্ড, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছরের সাজার রায় বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের একটি মামলায় যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ১৭ জনের দুই বছরের সাজার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। এ ছাড়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, বিএনপির সহপ্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁঁইয়া জুয়েল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা হাবিবুর রশিদ হাবিব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, ছাত্রদলের সাবেক নেতা বজলুল করিম চৌধুরী আবেদসহ অনেকের বিরুদ্ধে থাকা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে পুরনো দুটি নাশকতার মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ, শিমুল বিশ্বাস, শামা ওবায়েদসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকার আদালত। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মামলার কার্যক্রমও চলছে দ্রুতগতিতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর