সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ম্যাক্রোঁর সফরে নতুন দ্বার উন্মোচন

বিমানবন্দরে স্বাগত জানালেন প্রধানমন্ত্রী, লালগালিচা সংবর্ধনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ম্যাক্রোঁর সফরে নতুন দ্বার উন্মোচন

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নৈশভোজে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে দুই দিনের সফরে ঢাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। দীর্ঘ তিন দশক পর ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলেন। গতকাল রাত সোয়া ৮টায় নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষে একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন ম্যাক্রোঁ। রাত ৮টা ৩৪ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিমানবন্দরে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে লালগালিচা সংবর্ধনা ও রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়। এ সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তিন বাহিনীর প্রধান। ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফরকালে তার সঙ্গে অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী কেথেরিন কলোন্না। ১৯৯০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার সফরের ৩৩ বছর পর ঢাকা সফরে এলেন ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্ট।

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর এই সফরে তিনটি চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ, উড়োজাহাজ ক্রয় ও স্থানীয় সরকার প্রকল্পে অর্থায়নে সহযোগিতা। এ ছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা ইত্যাদি ইস্যুতেও আলোচনা হবে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। রাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে আয়োজিত নৈশভোজে। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আজ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সেখানে ম্যাক্রোঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও তাঁর ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন ম্যাক্রোঁ। বৈঠক শেষে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর এবং সব শেষে দুই নেতা একটি যৌথ প্রেস ব্রিফিং করবেন। এরপর আধা ঘণ্টা একান্তে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। সেখান থেকে ফ্রান্স দূতাবাসে দুপুরের ভোজে অংশ নেবেন ম্যাক্রোঁ। তারপর তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ফরাসি প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাবেন। যে কারণে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ : ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর এই সফর যেন সেই প্রমাণই দেয়। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে বর্তমানে ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। এই বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক বছরে ঢাকা-প্যারিসের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও নানা কারণে ম্যাক্রোঁর এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাক্রোঁর এ সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা।

গত কয়েক বছরে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থালেস। ম্যাক্রোঁর সফরকালে ২ দেশ দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের জন্য চুক্তি সই করবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থালেস তৈরি করলেও এটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছিল ইলন মাস্কের স্পেসএক্স। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তবে এবার স্যাটেলাইটটি থালেস তৈরি ও উৎক্ষেপণ করবে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত এ আলোচনাই হয়েছে। বাংলাদেশের বিমানবন্দরে রাডার সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ফ্রান্স কাজ করছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এগুলো বড় ধরনের চুক্তি।

এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ ইউরোপীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের কাছ থেকে দুটি কার্গোসহ ১০টি উড়োজাহাজ কিনতে সম্মত হয়েছে। দেশে স্যাটেলাইট তৈরির ইউনিট স্থাপনের বিষয়ে ফরাসি প্রস্তাবকেও স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাসের তথ্য মতে, দুই দেশের দ্বিপক্ষীক বাণিজ্য ১৯৯০ সালে ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে বর্তমানে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে।

ফ্রান্স বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রকৌশল, জ্বালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বেশ কয়েকটি খাতে কাজ করছে। ফরাসি দূতাবাস জানায়, এ পর্যন্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৫ প্রকল্পে সহায়তার জন্য ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ইউরো ঋণ ও ৩১ মিলিয়ন ইউরো অনুদান অনুমোদন দিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ফরাসি প্রযুক্তি ও জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণে উভয় পক্ষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখে আমরা রোমাঞ্চিত। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সফরের মধ্য দিয়ে কিছু প্রকল্প চূড়ান্ত করে নেওয়া ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করার সুযোগ হবে। ফরাসি দূতাবাসের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে বলা হয়, ফ্রান্সের সহায়তায় ও অংশীদারিত্বে বৈচিত্র্য আনতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী একটি দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও গভীর করার এটি একটি সুযোগ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করতে ফ্রান্স ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ উদ্যোগ নিয়েছে। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকা বাংলাদেশ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ উদ্যোগটি কার্যকর করতে চায়। তিনি আরও বলেন, অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু উন্নত দেশগুলো এখনো এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমরা ফরাসি প্রেসিডেন্টকে এই উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাব। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামে ফ্রান্সের গুরুত্ব অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে আমরা তাদের সমর্থন চাইব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক গণমাধ্যমকে বলেন, ফ্রান্স জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি আছে, যা অন্য দেশকে পরামর্শ বা চাপ দেয় না। তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে ফ্রান্স মধ্যপন্থা নীতি মেনে চলে। যুক্তরাষ্ট্র যখন এসব ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এটাই তো চাইবে।

 

সর্বশেষ খবর