সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শহর-গ্রাম সর্বত্র বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক

ঢাকায় দৈনিক গড়ে ৩৭টি এবং ৪০ মিনিটে একটি বিবাহ বিচ্ছেদ

জিন্নাতুন নূর

শহর-গ্রাম সর্বত্র বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে তালাকের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিবিএসের চলতি বছর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’-এর জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে তালাকের হার বেড়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪টি হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে শূন্য দশমিক ৭টি। এর মধ্যে গ্রামে বিবাহ বিচ্ছেদের  প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৫টি, আর শহরে হাজারে একটি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। বিবাহ বিচ্ছেদের তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, নারীরা পুরুষের তুলনায় দুই গুণেরও বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি, স্ত্রীকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং ভরণ-পোষণ দেওয়া হচ্ছে না- এমন কারণ দেখিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করা হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে তারা আগের তুলনায় স্বাধীনচেতা বেশি হওয়ায় এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, যারা মাত্র এক-দুই বছর সংসার করেছেন এবং যাদের সন্তান নেই তারাই বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। আর সালিশের মাধ্যমে সংসার টিকছে- এমন হার খুবই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ সময়ে এসে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেকে নিজের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এতে আগের চেয়ে বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন শরিফুল আজম। বিয়ের চার বছর পর স্ত্রী সম্পার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিচ্ছেদের আবেদন করেন। তিনি জানান, বিয়ের পর প্রথম কয়েক মাস সব ভালোই ছিল। হঠাৎ তার স্ত্রীর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। প্রায়ই সম্পা তার মায়ের বাড়িতে চলে যান। শরিফুল মোবাইলে যোগাযোগ করলেও সম্পা বিভিন্ন অজুহাতে তাকে এড়িয়ে যান। হঠাৎ স্বামীকে না জানিয়ে এক দিন বন্ধুদের নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যান। শরিফুল পরে তার বন্ধুদের কাছ থেকে সম্পার দেশের বাইরে যাওয়ার কথা জানতে পারেন। শরিফুল তখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতি অবহেলা তো ছিলই সংসারেও তার কোনো মন ছিল না। সবকিছু চিন্তা করেই শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ঢাকার একটি কল সেন্টারে কাজ করেন মাকসুদা লিমা। প্রেম করে বিয়ে করেন তার সহপাঠী সজল রহমানকে। বিয়ের শুরুতে ছোট একটি কোম্পানিতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করলেও এক সময় সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন সজল। এক পর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমদিকে নিজের উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ ও সজলের হাত খরচের টাকা দিলেও পরে আরও বেশি টাকা দেওয়ার জন্য লিমার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন সজল। এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে লিমা বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার একার উপার্জনে সংসার চলছিল এতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু মাদকাসক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কোনোভাবে দীর্ঘদিন এক ছাদের নিচে থাকা যায় না।’  ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫ হাজার ৫৯০টি আবেদন জমা পড়ে। এই হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় ৩৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। আর ৪০ মিনিটে একটি সংসার ভেঙেছে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, জানুয়ারিতে মোট তালাক হয় ৬৫০টি। এর মধ্যে নারীরা ৪৫০টি এবং পুরুষরা ২০০টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। ফেব্রুয়ারিতে মোট ৫৬৪টি বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে নারীরা ৩৯৯টি এবং পুরুষরা ১৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। মার্চে মোট বিচ্ছেদ হয় ৪৭৬টি। এর মধ্যে নারীরা ৩২৮টি এবং পুরুষরা ১৪৮টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এপ্রিলে মোট তালাক হয় ৪২৮টি। এর মধ্যে নারীরা ২৭৯টি এবং পুরুষরা ১৪৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। মে মাসে মোট ৭০৬টি বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে নারীরা ৫৭৭টি এবং পুরুষরা ১২৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। জুন মাসে মোট ৭০৮টি বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে নারীরা ৫৮৯টি এবং পুরুষরা ১১৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। জুলাই মাসে মোট বিচ্ছেদ হয় ৬৯০টি। এর মধ্যে নারীরা ৪৭৬টি এবং পুরুষরা ২১৪টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর আগস্ট মাসে মোট ৬৪৪টি বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে নারীরা ৪৩৯টি এবং পুরুষরা ২০৫টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট সাত মাসে ৩ হাজার ৮৮৬টি বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে নারীরা ২ হাজার ৫৯০টি এবং পুরুষরা ১ হাজার ২৯৬টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন।  ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) আবদুল্লাহ আল বাকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা আগের চেয়ে কমে এসেছে। একই সঙ্গে মানুষের মানিয়ে নেওয়ার যে ট্রেন্ড তাও কমে এসেছে। যা বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম একটি কারণ। যারা আমাদের কাছে আসেন তারা সাধারণত এই বিচ্ছেদ চান না। এক্ষেত্রে আমাদের কাছে পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি আসছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন (অঞ্চল-৫) সরকার বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি, স্ত্রীকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং ভরণ-পোষণ দেওয়া হচ্ছে না এমন কারণ দেখিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করা হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে তারা আগের তুলনায় স্বাধীনচেতা বেশি হওয়ায় এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা বিয়ে রেজিস্টারের তথ্যে, ২০২২ সালে জেলায় বিবাহ হয় ২০ হাজার ২১৩টি। আর বিচ্ছেদ ঘটে ৬ হাজার ৩৯০টি। দিনে গড়ে ৫৬টি বিবাহ হয় আর বিচ্ছেদ হয় ১৮টির মতো। শতকরা হিসাবে বিচ্ছেদের পরিমাণ প্রায় ৩২ শতাংশ। একইভাবে গাজীপুর জেলাতেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা এবং পাঁচটি উপজেলায় মোট বিয়ে হয় ২০ হাজার ২৮৫টি। বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে ১০ হাজার ৭১২টি। অর্থাৎ গত বছর গাজীপুরে প্রতি ৪৯ মিনিটে ভেঙেছে একটি সংসার। গাজীপুরে বিচ্ছেদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি কালিয়াকৈর উপজেলায় ঘটে। নিকাহ রেজিস্টারের কার্যালয় (কাজি অফিস) ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিবাহ বিচ্ছেদ সালিশি আদালত সূত্রে, তালাকের আবেদন নারীরাই বেশি করছেন। নারীরা বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে নিজের উপার্জনে স্বামীর ভাগ বসানো, ভরণ-পোষণে স্বামীর অক্ষমতা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মনের মিল না হওয়া ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করেন।  বিচ্ছেদের বিভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে নারীরা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর মাদকাসক্তি, যৌতুকের জন্য চাপ দেওয়া ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করেন। অন্যদিকে পুরুষদের বিচ্ছেদের কারণগুলোর মধ্যে আছে-স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক, সংসারে স্ত্রীর বাড়ির লোকদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি ইত্যাদি।

 

 

সর্বশেষ খবর