মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বন্ধুত্ব নতুন মাত্রায়

ব্যতিক্রমী সফরে ঢাকা মাতিয়ে গেলেন ম্যাক্রোঁ, বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নে সার্বভৌমত্বকে সমর্থন, দুই চুক্তি, আসবে ১০ এয়ারবাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্ধুত্ব নতুন মাত্রায়

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৈঠক করেন -পিআইডি

চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নের সার্বভৌমত্বকে সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে। গতকাল দুপুরে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্ট দুই দিনের সফরে এলেন বাংলাদেশ। ম্যাক্রোঁর সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের শীর্ষনেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতির স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। বিশেষ করে চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ফরাসি উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থার তৈরি নতুন ১০টি এয়ারবাস কিনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনের সূচনা করেছিলেন তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। শেখ হাসিনা বিবৃতিতে আরও বলেন, আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন যা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। ফ্রান্স সরকার জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দর্শনীয় ও ধারাবাহিক অগ্রগতিতে ফরাসি সরকারের আস্থা ও প্রশংসা ব্যক্ত হয়েছে। জিএসপি প্লাস প্রকল্পের অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রেখে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স। তিনি বলেন, তাই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স সরকার ও ফ্রান্সের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বৈঠকে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির লক্ষ্যে তারা বিশদ আলোচনা করেছেন এবং আমরা কিছু ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখিয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় এবং দায়িত্বশীল আবাসিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই এবং একটি টেকসই তহবিল গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আহ্বানের প্রশংসা করি। এ ছাড়া বৈঠকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিনিময় নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।

ফ্রান্স থেকে ১০টি এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতি : বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ফরাসি উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থার তৈরি নতুন ১০টি এয়ারবাস কিনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা। ‘এ৩৫০’ মডেলের ১০টি এয়ারবাসের জন্য প্রতিশ্রুতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি কর্মকর্তারা জানান, এ ৩৫০ মডেলের ওয়াইডবডির উড়োজাহাজের জন্য চুক্তিটি চূড়ান্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের সঙ্গে। ‘এয়ারবাস এ ৩৫০’ হলো একটি দূরপাল্লার, ওয়াইডবডির ও দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট জেট বিমান, যা এয়ারবাস কোম্পানি নির্মাণ করে। ৫১ বছরে বাংলাদেশের ২০টির বেশি বোয়িংসমৃদ্ধ উড়োজাহাজ রয়েছে। বেশির ভাগই ওয়াইডবডির বিমান। তবে এখনো কিছু ড্যাশ-৮ রয়েছে বহরে। এবার এয়ারবাস কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ সরকার।

দুই সমঝোতা স্মারক সই : ঢাকা ও প্যারিস অবকাঠামো, স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে দুটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উপস্থিতিতে নথিপত্রে সই করা হয়। চুক্তি দুটি হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এফডিএ)-এর মধ্যে ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে একটি ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) ও ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই)। বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান এবং ফ্রান্সের পক্ষে ঢাকায় ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) কান্ট্রি ডিরেক্টর বেনোইট চ্যাসেট চুক্তিতে সই করেন। বাংলাদেশে নগর পরিচালনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার জন্য ঋণ সহায়তা চুক্তিটি সই হয়। চুক্তির আগে হাসিনা ও ম্যাক্রোঁ দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র অন্বেষণে আলোচনা করেন।

পানসিতে ঘুরলেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ : বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পানসি নৌকায় ভ্রমণ করলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। গতকাল বেলা ১১টার দিকে মিরপুরে তুরাগ ও সাভারের কর্ণাতলী নদীতে ভ্রমণ করেন তিনি। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস এবং সামাজিক সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ যৌথভাবে এ ভ্রমণের আয়োজন করে।

মিরপুর বড়বাজার ইকো পার্ক ঘাট থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো এবং অন্যান্য সফরসঙ্গীকে নিয়ে তুরাগ নদে যাত্রা করে ‘ফ্লেচে ডি’অর’ নামে বড় আবারের পানসি নৌকাটি। এরপর সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণাতলী নদীতে প্রবেশ করে সেটি। সেখানে কিছু সময় কাটান তাঁরা। উপভোগ করেন নদীমাতৃক বাংলাদেশ। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে পানসি নৌকা ভ্রমণে অংশ নেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ; প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী; বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই; ফ্রেন্ডশিপের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রুনা খান এবং দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

আয়োজকরা জানান, নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশের জীবনজীবিকা এবং নদীতীরবর্তী গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরতে ফ্রান্স প্রেসিডেন্টের সম্মানে আয়োজন করা হয় এ নৌভ্রমণ। প্রায় ৭২ ফুট দীর্ঘ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিশেষ এ পানসি নৌকা নির্মাণ করেছে ‘ফ্রেন্ডশিপ’। সর্বোচ্চ ৩০ জন ধারণক্ষমতার নৌকাটি বাংলাদেশের নদী অববাহিকার বিভিন্ন সংস্কৃতির ধারকবাহক।

ঢাকা ছাড়লেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট : দুই দিনের সফর শেষে গতকাল দুপুরে ঢাকা ছাড়েন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। বিকাল ৩টায় তাঁকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। এর আগে রবিবার রাত ৮টায় ভারতে জি২০ সম্মেলন শেষে দুই দিনের সফরে ঢাকায় অবতরণ করেন ম্যাক্রোঁ।

ব্যতিক্রমী সফরে ঢাকা মাতিয়ে গেলেন ম্যাক্রোঁ : ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সাধারণত কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সফর কেন্দ্র করে ভিভিআইপি নিরাপত্তার প্রটোকল থাকে। সাজ সাজ রব থাকে চারদিকে। ম্যাক্রোঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সফর ঘিরে কড়া নিরাপত্তা থাকলেও শক্তিধর এ দেশটির প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ঢাকা দেখার আগ্রহ প্রকাশের কারণে অনেক কিছু যেন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল। অল্প সময়ের সফরে তিনি মোটামুটি ঢাকা মাতিয়ে গেছেন। বিশেষ করে নিরাপত্তা আর অনাড়ম্বর আয়োজন পেছনে ফেলে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ধানমন্ডি লেকের গাছপালার ভিতর দিয়ে হেঁটে চলা, জলের গানের শিল্পী রাহুল আনন্দের বাসায় যাওয়া, তুরাগ নদে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, রাস্তার পাশে শিঙাড়ার দোকানে দাঁড়ানো সবই তাঁর ব্যতিক্রমী সফরের প্রমাণ। ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলন শেষে রবিবার রাত ৮টার দিকে ঢাকায় পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দর থেকে সম্প্রতি চালু হওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসেন ম্যাক্রোঁ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকায় আসেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনা। প্রথাগতভাবে প্রটোকল অনুযায়ী ওই রাতে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য এ সময় উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজের আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ম্যাক্রোঁ। এরপর নিজের আগ্রহের জায়গা জলের গান খ্যাত শিল্পী রাহুল আনন্দের ধানমন্ডির বাসায় যান রাত প্রায় ১২টায়। সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুলের বাসায় প্রায় ২ ঘণ্টা কাটান তিনি। ওই সময় শিল্পীর গান শোনেন ম্যাক্রোঁ। রাহুল আনন্দ যে একতারা বাজিয়ে গান গেয়েছেন সেটি উপহার দেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে। তিনি সেটি হাতে পেয়ে বাজানোর চেষ্টাও করেন। অবশ্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে রাহুল আনন্দও পেয়েছেন অন্যরকম উপহার। তাঁকে নিজে ব্যবহার করেন তেমন একটি কলম উপহার দিয়ে তা নিয়ে গান লেখার অনুরোধ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তুরাগ নদে ঘুরতে গেলে রাস্তার পাশের একজন বিক্রেতা তাকে শিঙাড়া-সমুচা-জিলাপি খাওয়ার অনুরোধ করেন। এ সময় তাঁকে দোকান থেকে জিলাপি টিস্যুতে মুড়িয়ে হাতে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এ সফরটি অন্য যে কোনো ভিভিআইপি সফরের থেকে আলাদা। সাধারণভাবে যে কোনো ভিভিআইপি সফরে জাঁকজমক পর্ব বেশি থাকে। কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন, যা অন্যদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় না।

বাংলাদেশে ফ্রান্সের বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা : ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজতে ঢাকায় এসেছিলেন বলে তাঁর সরকারি বাসভবন এলিসি প্রাসাদ থেকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে সফররত ফরাসি প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন থেকে জানা গেছে, ফ্রান্স বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, অ্যারোনটিকসসহ কয়েকটি কৌশলগত প্রকল্পে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ৮ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্টের বাসভবনের এক কর্মকর্তা ব্রিফিংয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন ফ্রান্স এখন বাংলাদেশকে কতটা ভিন্নভাবে দেখছে।

ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ‘বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সংকটসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে। তবু দেশটি গত ১০-১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে।’ তিনি আরও বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে বাধা দেয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে বিস্তৃত উন্নয়ন কর্মসূচি গড়ে তুলেছেন। তিনি কৌশলগত মিত্র ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন এবং নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছেন। তিনি বৈশ্বিক সরবরাহ-শৃঙ্খলের অংশ হতে চান।

এলিসি প্রাসাদ বাংলাদেশকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিক থেকে একটি ‘মডেল রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছে দেশটির ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ। এটি ঋণদাতাদের চাপে সংকুচিত নয়। যেমনটি দেখা যাচ্ছে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি, অপার সম্ভাবনা ও ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবণতা আছে। সূত্রটি আরও জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩০টি বৃহৎ অর্থনীতির একটিতে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এ প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। যেসব খাতে ফ্রান্স শক্তিশালী সেসব খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারি করতে চায়।

ফ্রান্স মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থালেস ইতোমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাডার ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ করছে। একই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করা বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তৈরি করেছিল। ফ্রান্স থেকে আরেকটি স্যাটেলাইট কেনার বিষয়ে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড চেষ্টা করছে। এয়ারবাসের কাছ থেকে ১০টি বিমান কেনার বিষয়েরও চেষ্টা চলছে। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময় দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট সই করে। অ্যারোনটিকস ছাড়াও ফ্রান্স বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি ফ্রান্স রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ইস্যুতে বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর