মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ই-কমার্স প্রতারণায় তিন বছর জেল

কর্তৃপক্ষ গঠনে হচ্ছে আইন

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ই-কমার্স প্রতারণার মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর এখন সরকার এমন একটি আইন করতে যাচ্ছে, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড, অনাদায়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড! শুধু তাই নয়, এ আইনে আমলযোগ্য সব অপরাধকেই জামিনযোগ্য বলা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা একে ই-কমার্স প্রতারণায় ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাদের মতে, এত অল্প পরিমাণ শাস্তির বিধান রেখে প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে ইভ্যালি, কিউকমের মতো প্রতিষ্ঠানের ই-কমার্স প্রতারণা ঠেকানো যাবে না।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। ই-কমার্স বাণিজ্য তদারকির পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত অপরাধে মামলা ও জরিমানা করতে পারবে ওই কর্তৃপক্ষ। ফলে অনলাইনে প্রতারণা ভবিষ্যতে কঠিন হয়ে যাবে। ‘ডিজিটাল বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০২৩’ শিরোনামে আলোচ্য আইনটির খসড়া তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খসড়া আইনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করলে অনলাইন বিক্রেতাকে দুই বছরের কারাদণ্ড, অনাদায়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড; নির্ধারিত সময়ে পণ্য বা সেবা সরবরাহ না করলে মূল্যের তিন গুণ জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড; নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা; অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল বা গিফট কার্ড, ওয়ালেট, ক্যাশ ভাউচার করলে ছয় মাস কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা; ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে লটারি আয়োজন করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার মতো ছোট ছোট কিছু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ আইনের যে কোনো ধারা লঙ্ঘনে দায়েরকৃত মামলা প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট আদালতে বিচার্য হবে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা-ই থাকুক, বিধিমালায় বর্ণিত সব অপরাধ জামিনযোগ্য হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপনকান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ই-কমার্স প্রতারণা, নিবন্ধন ও তদারকির বিষয়গুলো দেখার জন্য কোনো একক কর্তৃপক্ষ নেই। এ আইন অনুমোদন হলে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ হবে, যাদের কার্যক্রমই হবে ডিজিটাল প্রতারণার বিষয়গুলো তদারকির পাশাপাশি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা। ভুক্তভোগীরা এ ধরনের আইন করার উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও শাস্তির বিধান দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। রাজধানীর মিরপুরের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সুমন (ছদ্মনাম) জানান, অনলাইনে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণা হচ্ছে। গত মাসেও এমটিএফই নামে একটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়ে অনলাইন থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে। এত হালকা শাস্তির বিধান দিয়ে হাজার কোটি টাকা প্রতারক কোম্পানিগুলোকে আটকানো যাবে না। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান জানবে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে তিন বছরের কারাদণ্ড এড়ানোর সুযোগ আইনেই রয়েছে, তখন তারা অনলাইন প্রতারণায় আরও উৎসাহী হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য এমনটি মনে করছেন না। তাদের ধারণা, আলোচ্য আইনের মাধ্যমে যখন একটি কর্তৃপক্ষ গঠন হবে, তখন সব প্রতিষ্ঠানকেই এ কর্তৃপক্ষ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। আর নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেনসহ সব ধরনের কার্যক্রম তদারকি করবে গঠিত কর্তৃপক্ষ। এমনকি পণ্য বিক্রিসহ অনলাইনের তথ্যভান্ডারও পরিদর্শন করবে তারা। ফলে চাইলেও কেউ প্রতারণা করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ই-কমার্সের বিষয়গুলো দেখতে অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল আছে, যাদের মামলা বা জরিমানার এখতিয়ার নেই। অভিযোগগুলো দেখছে আবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এ ছাড়া ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনডিটি (ডিবিআইডি) নিবন্ধন দিচ্ছে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস, যাদের নিজেদেরই লোকবলের অভাব রয়েছে। এ কারণে আইনের মাধ্যমে একটি পৃথক ‘ডিজিটাল বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; যারা ডিজিটাল বাণিজ্যের সামগ্রিক তদারকির পাশাপাশি এর নিবন্ধন, অভিযোগ, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা এবং আদালতে মামলা দায়ের ও জরিমানার এখতিয়ার পাবে।

যেভাবে গঠন হবে কর্তৃপক্ষ : একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যান করে ‘ডিজিটাল বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন হবে। যুগ্মসচিব পর্যায়ের তিনজন সদস্য থাকবেন। এর কেন্দ্রীয় দফতর থাকবে ঢাকায়। তবে সরকার প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যে কোনো স্থানে এক বা একাধিক শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে। ডিজিটাল বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীন একটি পরামর্শক কাউন্সিল থাকবে। আর কর্তৃপক্ষ থাকবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা : ই-কমার্স বা ডিজিটাল বাণিজ্যের প্রসার, শৃঙ্খলা রক্ষা, বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি ও অপরাধ প্রতিরোধে এ আইনে উল্লিখিত সবকিছুই তদারকি করবে এই কর্তৃপক্ষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য ও সেবা কেনাবেচা ও সংরক্ষণ হয় কি না; কোনো ওষুধপণ্য মোড়কে সঠিক ব্যবহারবিধি, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছাড়া অনলাইনে বিক্রি হয় কি না; অসত্য ও অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন বা বিক্রয় প্রস্তাব দিয়ে ক্রেতা ও গ্রাহকদের প্রতারণার বিষয়গুলো তদারকি করবে প্রস্তাবিত কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত অনলাইন কার্যক্রম এবং সরেজমিনে পরিদর্শন, ডিজিটাল বাণিজ্যেও দেশি উদ্যোক্তাদের বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি বাড়াতেও এই কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। ডিজিটাল বাণিজ্য ও ই-কমার্স সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত করার পাশাপাশি ওই কাজে সহায়তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে। প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিবিআইডি নিবন্ধন দেবে এই কর্তৃপক্ষ। প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলে আবার সেই নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতাও থাকবে এই কর্তৃপক্ষের হাতে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইভ্যালি, কিউকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে যে অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন প্রচার করত বা লটারির আয়োজন করত, প্রস্তাবিত আইনে সে বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি সব ধরনের জুয়া বা বেটিং কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর