বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারুনকে এবার রংপুরে বদলি, নানামুখী তথ্য

প্রথম হাত তোলেন এপিএস মামুন : ডিবি তদন্তে পাঁচ দিন চেয়েছে কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

হারুনকে এবার রংপুরে বদলি, নানামুখী তথ্য

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাময়িক বরখাস্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে এডিসি সানজিদা আফরিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট ছিল! স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছিল সানজিদা ও তার স্বামী আজিজুল হক মামুনের সঙ্গে। সমাধানের জন্য পারিবারিকভাবে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। সবশেষ গত শনিবার রাতে রাজধানীর শাহবাগে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে হারুন ও সানজিদার অবস্থানের বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে ছুটে যান আজিজুল হক মামুন। ডেকে আনেন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের। এরপর ন্যক্কারজনক ঘটনার অবতারণা হয়। কথাগুলো বলছিলেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। বিষয়টি তদন্তাধীন হওয়ায় নিজের নাম প্রকাশে রাজি হননি তিনি। অন্যদিকে, এডিসি হারুনের গায়ে প্রথমে হাত তোলা হয় বলে ডিএমপির পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও তা নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা বলছেন, এপিএস আজিজুল যদি এডিসি হারুনকে মারধর করে থাকেন, তাহলে আজিজুলকে মারধর না করে, ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে থানায় নিয়ে কেন মারধর করা হলো?

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ডিএমপির রমনা জোনের সাবেক এডিসি হারুন-অর-রশীদকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখার এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।

তদন্ত সূত্র বলছে, স্ত্রীর পাশে এডিসি হারুনকে দেখে এপিএস আজিজুল নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার গায়ে হাত তোলেন। নিজে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং সঙ্গে থাকা বর্তমান নেতারা থাকায় এমন আচরণটি করেছিলেন আজিজুল। তবে বেঁধে দেওয়া দুই দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। আরও দু-তিন দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্য ডিএমপির নিউমার্কেট জোনের এডিসি মো. শাহেন শাহ। তিনি বলেন, তদন্তের জন্য আমরা পাঁচ কার্যদিবস চেয়েছি। কারণ এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি।

আহত ছাত্রলীগ নেতাকে দেখতে ডিএমপি কমিশনার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈমকে গতকাল দুপুরে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ সময় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. রেজাউর রহমানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় ডিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমকে জানান, শাহবাগ থানার ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম আহত হয়েছেন। আমি মূলত তার শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খবর নিতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছি, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সে এখনো কিছুটা অসুস্থ। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক দিন সময় লাগবে। কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় এডিসি হারুনকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছে। আরেকজন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) মোস্তফাকেও থানা থেকে সরানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়সহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি ঘটনার সার্বিক বিষয় তদন্তকালে দেখবে কেন ঘটনাটি ঘটল এবং কে কে কতটুকু দোষী। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে পাঠাব। ঘটনার সময় এডিসি হারুনের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পর সার্বিক চিত্রটি আমাদের কাছে আসবে। এ মুহূর্তে কার কতটুকু দোষ তা বলা যাচ্ছে না। আমরা আপতত দৃষ্টিতে দেখছি, একজন ছাত্রকে থানার ভিতরে মারধর করা বেআইনি। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ওইটুকু অ্যাকশন নিয়েছি। এর মধ্যে যদি তদন্তে অন্য কোনো বিষয় আসে সেসব বিষয়ও দেখা হবে।

অন্যদিকে, নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, উনি (এপিএস মামুন) একজন সরকারি কর্মকর্তা। পুলিশের ওপর প্রথম হামলাটা তিনিই করেছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। অথবা তারও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিল, তাদের অবহিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে হাসপাতালের ভিতরে অসুস্থ মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করেন। তার চশমা ভেঙে ফেলেন এবং তার ওপর আঘাত করেন। এটা সঠিক করেছেন কি না তা আমি জানি না, তবে এর তদন্ত হওয়া উচিত। থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের ঘটনার সূত্রপাত বারডেম হাসপাতাল থেকে বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, পুলিশ কখনো ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের দায় নেয় না। আমি মনে করি এ ঘটনায় স্বাধীনভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আসল ঘটনা জানতে পারব আমরা।

যা বলছে মানবাধিকার কমিশন : গতকাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। ব্যক্তিগত আক্রোশকে কেন্দ্র করে থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ফুটে উঠেছে। তদন্তসাপেক্ষে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনিব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের এডিসি হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিষয়টি কমিশনকে জানাতে সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ৯ সেপ্টেম্বর রাতে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানা হেফাজতে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে নির্যাতন করেন এডিসি হারুন অর রশিদ। আহতরা হলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম। ভুক্তভোগী ও তাদের সহপাঠীদের অভিযোগ, এডিসি হারুন অর রশিদ তাদের থানায় নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দেওয়ার পরও হারুনের সঙ্গে ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য মিলে তাদের বেদড়ক পেটানো হয়েছে।

এডিসি সানজিদা যা বললেন : একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এডিসি সানজিদা আফরিন বলেন, ‘তার স্বামী আজিজুল হক মামুনই প্রথমে এডিসি হারুন অর রশিদকে আঘাত করেছেন। বেশকিছু দিন আমার কার্ডিয়েট সমস্যা হচ্ছিল। ২০১৯ সাল থেকে আমি হাইপার টেনশনের মেডিসিন খাচ্ছি।’

সানজিদা বলেন, গত চার-পাঁচ মাস ধরে সমস্যাটা বেড়ে যায়। শনিবার ব্যথা বেড়ে গেলে ফ্রি সময় থাকায় ডাক্তার দেখাতে চাই। আমি যে ডাক্তারকে দেখাই, তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে এডিসি হারুন স্যারকে একটি সিরিয়াল ব্যবস্থা করে দিতে বলি। তিনি ওসির মাধ্যমে সিরিয়ালের ব্যবস্থা করে দেন। সন্ধ্যা ৬টার পর আমি সেখানে যাওয়ার পরে দেখলাম, যেই ডাক্তারের অ্যাপায়নমেন্ট নেওয়া হয়েছে তিনি একটি কনফারেন্সে আছেন। বিষয়টি হারুন স্যারকে জানালে, তিনি আশপাশে থাকায় হাসপাতালে আসেন। তিনি এসে একজন ডাক্তারকে ব্যবস্থা করেন। তাকে দেখানোর পর বেশ কিছু টেস্ট দেন। ঘটনার সময় তিনি ইটিটি রুমে ছিলেন দাবি করে সানজিদা বলেন, ‘ইটিটি করানোর ১৫-২০ মিনিট পর আমি বাইরে হট্টগোলের শব্দ শুনি। প্রথম যে শব্দটা কানে আসে যে স্যারই (এডিসি হারুন) চিৎকার করে বলছেন ‘ভাই আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন? আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না’। আমার প্রথমে ধারণা হয়েছিল হয়তো অন্য কারও সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আমি দেখতে পাই আমার স্বামী (আজিজুল হক মামুন)। উনি ওখানে কী করছিলেন এবং কেন গিয়েছিলেন আমি জানি না। তবে, উনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। উনার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছেলে ছিল, আমি তাদের চিনি না। একপর্যায়ে স্যারকে (এডিসি হারুন) মারতে মারতে ইটিটি রুমে নিয়ে এলেন। স্যার তাদের হাত থেকে বাঁচতে ইটিটি রুমের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ান।

সানজিদা বলেন, ‘এরপর আমার স্বামী তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বললেন, ‘এই ভিডিও কর’। এরপর সবাই ফোন বের করে ভিডিও করতে থাকেন। যখন তারা ভিডিও শুরু করে তখন আমি আমার স্বামী এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের সঙ্গে চিল্লাচিল্লি করছিলাম। এরপর আমি যারা ভিডিও করছে তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এ সময় তাদের হাতের সঙ্গে লেগে আমার হাতেও আমি সামান্য ব্যথা পাই। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না সে অবস্থায় কেউ আমার ভিডিও করুক। আর আমার স্বামীর সঙ্গে যেসব ছেলে ছিল তাদের কাউকে চিনতামও না।’

অনুমতি ছাড়া এডিসি সানজিদা বক্তব্য দিতে পারেন না- ডিএমপি কমিশনার : অনুমতি ছাড়া ডিএমপির ক্রাইম বিভাগে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের এভাবে বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। রাতে ডিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।

সর্বশেষ খবর