শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পুড়ে ছারখার কৃষি মার্কেট

১৮ জুয়েলারিসহ ৪ শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুড়ে ছারখার কৃষি মার্কেট

পোড়া দোকানে সম্বল পাওয়ার চেষ্টা -রোহেত রাজীব

ফের ভোররাতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে রাজধানীর কৃষি মার্কেট। এর আগে এপ্রিলে ভোরের আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেট। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। ভোর পৌনে ৪টায় মার্কেটের ডান দিকে এ আগুনের সূত্রপাত বলে জানা গেছে। এরপর একে একে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে যায়। তাদের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেন সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।

প্রায় ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি, দোকান মালিক সমিতি এবং দোকান ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ও আঞ্চলিক কর্মকর্তা এবং ঢাকার জেলা প্রশাসক। ভয়াবহ এ আগুনে ওই মার্কেটের অন্তত ১৮টি জুয়েলারি দোকান পুড়ে গেছে। স্বর্ণের দোকান ছাড়াও মার্কেটটিতে কাপড়, প্লাস্টিকের মালামাল, ক্রোকারিজ ও ব্যাগের দোকান ছিল। এসব দোকানও পুড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মার্কেটটিতে ৪ শতাধিক দোকান ছিল। এসব দোকানে কাজ করতেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। এখানে সবজির পাশাপাশি জুতা, কাপড়, জুয়েলারিসহ অনেক ধরনের দোকান ছিল। মুদি, চাল, তৈজসপত্র, হার্ডওয়্যার, প্লাস্টিক, রূপসজ্জার পণ্যও বিক্রি হতো। শুধু মার্কেটের এক পাশে থাকা মাছ-মাংসের দোকানগুলোয় আগুন পৌঁছাতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের দাবি, পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোয় কোটি কোটি টাকার মালামাল ছিল। এ আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

মার্কেটের নতুন কাঁচাবাজার মালিক সমিতির অফিস সহকারী মুশফিকুর রহমান লিটন জানান, কাঁচাবাজারের প্রবেশমুখে হক বেকারি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বুধবার শেষ রাতে এক নিরাপত্তাকর্মী এসে আমাকে জানান হক বেকারি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি আগুন ধরে গেছে। পরে অফিসে এসে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিই। কিন্তু তারা কল ধরে নাই। পরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিই। তারা বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। গাড়ি পাঠাচ্ছি। এর আধা ঘণ্টা পর দুটি ছোট গাড়ি আসে। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তবে আগুনের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে হতে পারে।’

আগুনে পুড়েছে যত দোকান : আগুনে মার্কেটের ৪ শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেট ও কাঁচাবাজারে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সাত-আট শ দোকান ছিল। তারা জানান, হক বেকারিতে আগুন লাগার পর বাতাসে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে। মার্কেট বন্ধ থাকায় ফায়ার সার্ভিস প্রথমে এসে ভেতরে ঢুকতে পারেনি। এজন্য আগুন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেছেন, অবৈধ দোকানগুলো ছিল ফুটপাতে। সিটি করপোরেশন থেকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া ছিল ৩১৭টি। এর মধ্যে পুড়েছে ২১৭টি।

পুড়েছে ১৮টি স্বর্ণের দোকান : আগুনে পুড়ে যাওয়া ১৮টি স্বর্ণের দোকানের মধ্যে আছে আলিফ জুয়েলার্স, হেনা জুয়েলার্স, দুবাই জুয়েলার্স, সিঙ্গাপুর জুয়েলার্স, মুন জুয়েলার্স, রিয়াদ জুয়েলার্স ও মা জুয়েলার্স। দুবাই জুয়েলার্সের মালিক আমির হোসেন বলেন, ‘আমার দুটি জুয়েলারির দোকান ছিল। ভোর ৪টায় খবর পেয়ে মার্কেটে আসি। তখনো আমার দোকানে আগুন লাগেনি। মার্কেট বন্ধ থাকায় সামান্য কিছু মালামাল সরাতে পারলেও সব সরাতে পারিনি। দুই দোকানে কয়েক কোটি টাকার জুয়েলারি মালামাল ছিল।’

মার্কেটে ছিল না ফায়ার সেফটি : ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফুটপাত ও সড়কে থাকা দোকান ও মানুষের কারণে অগ্নিনির্বাপণে সমস্যা হয়েছে। এখানে পানিরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, ‘এ মার্কেটটিকে বারবার নোটিস দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে গণসংযোগ করা হয়েছে। সচেতনতার প্রোগ্রাম যেভাবে আমরা করেছি সেভাবে তারা সাড়া দেয়নি। এ মার্কেট কিছুটা বঙ্গবাজার টাইপের। এখানে ভিতরে অনেক সাবওয়ে ছিল ছোট ছোট। রাত ৩টা ৫২ মিনিটে আমরা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। ১৭টি ইউনিটে ১৫০ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করেছেন। আমাদের সঙ্গে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী সহযোগিতা করেছে।’ তবে ঢাকা মহানগর ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান টিপু দাবি করেছেন, ফায়ার সার্ভিস কিংবা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই ফায়ার সেফটি বাড়ানোর বিষয়ে কিংবা ‘মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ’ এমন নোটিস ব্যবসায়ীরা পাননি। তিনি বলেন, আগুনে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। দোকান মালিক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ফারুক আহমেদ নামে ওই মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, এ মার্কেট যদি ঝুঁকিপূর্ণই হবে, তবে বন্ধ করা হলো না কেন? আগুন লাগলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পায় দোকান মালিক, কেন? আগুন লাগলে ক্ষতি তো হয় ব্যবসায়ীর, দোকান মালিকের হয় না। যারা দোকানের মালিক তারা তো ভাড়া দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা ভাড়া নিচ্ছেন, কিন্তু আগুনে ক্ষতি হচ্ছে দোকানে যিনি ব্যবসা করছেন তার।

তালিকা করা হয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের : অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের তালিকা করতে বুথ খুলেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। গতকাল দুপুর ২টায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে অস্থায়ীভাবে একটি বুথ বসিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করার নির্দেশনা দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, দোকানের তালিকা করার ক্ষেত্রে মূল মালিকের নামে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দপত্র, দোকান ভাড়া দেওয়া থাকলে তার প্রমাণপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও ট্রেড লাইসেন্স দেখে নিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া দোকান কর্মচারীদেরও তালিকা করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের পরিচয়পত্র ও বেতনের প্রমাণপত্র দেখা হয়।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহমান বলেন, ‘আমরা তালিকা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাব। সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ কিংবা অন্য সহায়তা দেওয়া হবে।’ জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি শুরু করে।

অগ্নিনির্বাপণে ব্যবস্থা নিতে সরকার ব্যর্থ, বলছেন জি এম কাদের : গতকাল দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি বলেন, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে লাগা আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। আগে থেকে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এসব ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

মানবিক সহায়তায় আনসার : অগ্নিকাণ্ডে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা প্রদান, উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বাহিনীর পক্ষ থেকে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হয়।

উদ্ধারকাজে হিজড়ারা : উদ্ধারকাজে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অংশ নেন এলাকার হিজড়ারাও। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা উদ্ধারকাজ করেন। এতে তাদের কেউ আহত হলেও থেমে থাকেননি। হিজড়ারা বলছিলেন, ‘এখান থেকে আমাদের পেটে ভাত জোটে। এগুলো আমাদেরই দোকান। আমরা যে যা পারছি তা উদ্ধার করেছি, বাঁচানোর চেষ্টা করেছি।’

আশপাশের সড়কে যানজট : আগুনের ঘটনায় মোহাম্মদপুরের কয়েকটি এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে আশপাশের সড়কে। এতে মিরপুর সড়কে দেখা যায় তীব্র যানজট। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন এ পথের যাত্রীরা। অনেকে বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যাওয়া শুরু করেন। গতকাল সকালে কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদ গেট এলাকায় ধীরগতিতে যানবাহন চলতে দেখা গেছে। মূল সড়কে উঠতে না পেরে অলিগলিতে রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির জট দেখা গেছে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি : কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মালামাল, কাপড়চোপড় নিজের কাঁধে বহন করে উদ্ধারের কাজে অংশগ্রহণ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ছাড়া আশপাশ এলাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশ।

 

রাজধানীর কৃষি মার্কেটে আগুন

(১) রাজধানী কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার পর উদ্ধার তৎপরতা


(২) ক্ষতিগ্রস্তদের কান্না


(৩) আগুন নেভাতে কাজ করছে সাধারণ মানুষ


(৪) পুড়েছে চালসহ পণ্য

সর্বশেষ খবর