শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর

মির্জা মেহেদী তমাল

অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর

অরক্ষিত হয়ে পড়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৪ স্তরের নিরাপত্তা ডিঙিয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই একটি শিশুর উড়োজাহাজে চড়ে বসা, কাস্টমস গুদাম থেকে সোনা হাওয়া হয়ে যাওয়া, রানওয়ে থেকে কার্গোর মাল গায়েব করে ফেলার মতো ভয়াবহ সিরিজ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংরক্ষিত এলাকায় অবাধ যাতায়াত, নিত্য চুরির ঘটনা, চোরাকারবারি চক্রের দৌরাত্ম্য, অপরাধীদের বাধাহীন চলাফেরায় দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল এ স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিমানবন্দরে এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি নজিরবিহীন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশের স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে সরকার যখন উদ্বিগ্ন, ঠিক তখনই বিমানবন্দরের এমন ভঙ্গুর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল বিমানবন্দর এখন চোরাকারবারি চক্রের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এ সোনা চোরাচালান ও মুদ্রা পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে তালিকাভুক্ত দাগি অপরাধীরা। এরাই বিমানবন্দর থেকে সোনার চালান বাইরে বের করে নিয়ে আসে। বৈদেশিক মুদ্রা পৌঁছে দেয় বিমানবন্দর পর্যন্ত। যে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি কাটানোসহ নানা কাজে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে থাকে চোরাকারবারি চক্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভুয়া নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস (ডিউটি পাস) ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের পাস দিয়ে হ্যাঙ্গার গেট, এয়ারফ্রেইড গেট, কার্গো ভিলেজ গেটসহ বিভিন্ন গেট ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অ্যাপ্রোন (যেখানে বিমান দাঁড়ানো থাকে বা অবস্থান করে থাকে) এলাকায় অবাধে ঢুকে যাচ্ছে। সূত্র জানান, বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক ২৯টি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, এপিবিএন, এসবি, ডিবি, র‌্যাব এবং বিভিন্ন এয়ারলাইনস ও সংস্থা। তারা ডিউটি চলাকালে সিএএবি নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস ব্যবহার করে। আর এসব পাস ইস্যু করে সিএএবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সিএএবি কর্তৃপক্ষের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধ নিরাপত্তা পাস ও ভুয়া ডি-পাস ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত লোক প্রবেশ করছে।

নিরাপত্তাবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সাম্প্রতিক এক সেমিনারে বলা হয়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের নাজুক বিমানবন্দরগুলোর একটি। পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস এবং বিমানের কর্মকর্তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ায় নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়ে গেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। এখানে যে-কেউ একটি তদারকি ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সহজে প্রবেশ এবং বেরিয়ে যেতে পারে। সারা বিশ্বেই এখন বিমানবন্দরগুলো সন্ত্রাসীদের প্রধান লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বিমানবন্দরের শিথিল নিরাপত্তাব্যবস্থা নাশকতার সুযোগও সৃষ্টি করবে।

সর্বশেষ শনিবার রাতে বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে এক শিশুর কুয়েতি উড়োজাহাজে চড়ে বসার ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি সামনে আসে।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনায় প্রথমে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, ‘কীভাবে ইমিগ্রেশন পার হলো সেটা আমারও প্রশ্ন।’ তিনি ধারণা করছেন ইমিগ্রেশন করার সময় হয়তো কোনো পরিবারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেও পার হয়ে গেছে। তার পরও এটা তদন্ত করে দেখা হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখছেন কীভাবে শিশুটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছিল এবং ফ্লাইটে উঠেছিল। তারা দেখতে পান, ইমিগ্রেশন, অ্যাভসেক তল্লাশি ও সিকিউরিটি চেক না করে শিশুটি নির্বিঘ্নে ফ্লাইটে উঠে যাচ্ছে। এটি দেখে হতবাক সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে বহনকারী ভিভিআইপি ফ্লাইটটি এয়ারপোর্ট ত্যাগ করার মাত্র ১০ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের এমন চিত্র পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, শিশুটি কীভাবে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল এবং কীভাবে নিরাপত্তা স্তরগুলো পার হলো তা তদন্ত করে খুঁজে বের করা হবে। যারা গাফিলতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়ীদের শাস্তি দেওয়া হবে। বেবিচক চেয়ারম্যান তাঁকে জানিয়েছেন যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে। এর আগে বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকা রানওয়ে সাইট থেকে রাতের অন্ধকারে ২০ কোটি টাকার মূল্যবান মালামাল চুরি হওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়। এ মালামালের মধ্যে ১০-১২ কোটি টাকার অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়ে ভাঙা কংক্রিট স্লাব ছিল। এ ছাড়া রানওয়ে তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের মূল্যবান পণ্যসামগ্রীও রক্ষিত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে এসব পণ্যসামগ্রী বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে রাডার ভবন ও রানওয়ে ১৪ প্রান্তের কাছে স্তূপ আকারে পড়ে ছিল। সম্প্রতি থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের এক্সপোর্ট কার্গো ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে গেলে এ ভয়াবহ চুরি ধরা পড়ে। ১৭ জুলাই বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া এক চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অনুপ কুমার তালুকদার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিষয়টি যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমানবন্দরের রানওয়ে এলাকাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এখানে যে-কেউ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে কিংবা বের হতে পারবে না। তা ছাড়া এত বড় অঙ্কের চালান কেউ হাতে করেও নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য ট্রাক কিংবা ভারী যানবাহন রানওয়েসংলগ্ন এলাকায় নিয়ে পণ্যসামগ্রী বের করতে হবে। এজন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় গেট পাসসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন লাগার কথা। কারণ এগুলো সরকারি সম্পত্তি। তা ছাড়া রানওয়েসংলগ্ন এলাকা থেকে যে কোনো পণ্যসামগ্রী অপসারণ করতে হলে অবশ্যই টেন্ডার কিংবা নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার নিয়ম। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, এ ঘটনা সরকারি সম্পত্তি দিনদুপুরে ডাকাতির মতো। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের টার্মিনাল ভবন ও রানওয়ে সাইট দুটি অংশে ভাগ করে এর উন্নয়ন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে সিভিল ডিভিশন-১। চুরি হওয়া প্রতিটি স্লাব ২৫ ফুট বাই ২৫ ফুট আকারের। থিকনেস ২৬ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এ ধরনের একটি স্লাব বানাতে ১৩৬৫ সিএফটি কংক্রিট ও ডাওয়েল বার ব্যবহার করতে হয়। পুরনো স্লাব ভাঙলে ১৩৬৫ সিএফটি আকারের ভাঙা স্লাব পাওয়া যায়। ঢাকা শহরসহ সারা দেশে এসব পুরনো ভাঙা স্লাব ক্র্যাশিং মেশিনে গুঁড়া করে তা থেকে প্রাপ্ত স্টোন সিপস পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এভাবে রিসাইক্লিন করে নতুন স্লাব তৈরির শত শত কারখানা ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় পুরনো স্লাব ভাঙা স্টোন সিপস ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট বিক্রি হয়ে থাকে।

 

সর্বশেষ খবর