শিরোনাম
শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
সংসদে প্রধানমন্ত্রী

সামনে নির্বাচন সিদ্ধান্ত জনগণের

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সামনে নির্বাচন। জনগণ ভোট দিলে এখানে (সরকারি দলে) থাকব, না দিলে ওইদিকে (বিরোধী দলে) যাব, কোনো অসুবিধা নেই। তবে যতদিন আছি জনগণের কল্যাণ করে যাব। সিদ্ধান্ত জনগণের। আমরা জনগণের ওপর সব ছেড়ে দিচ্ছি। গতকাল রাতে চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের ২৪তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে জন্য দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। কোনো চক্রান্তের কাছে বাংলাদেশের জনগণ মাথা নত করেনি, করবে না। বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে। আজকের বাংলাদেশ, বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। এই অগ্রযাত্রা যেন কেউ ব্যাহত করতে না পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে বদলে গেছে, দেশের মানুষ ভালোভাবে বসবাস করছে, উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে- এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। টানা তিন মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল বলেই আমরা দেশের এত উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা যাতে অব্যাহত থাকে সে জন্য দেশের মানুষের কাছে আহ্বান জানাই।

ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে রাতে জাতীয় সংসদের সমাপনী বক্তব্য রাখেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সভাপতির আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার সংসদ অধিবেশন সমাপ্তি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পাঠ করেন। মাত্র ৯ কার্যদিবস চলা এই অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি বিল পাস হয়েছে। অক্টোবরে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন বসবে। সেখানে বাকি বিলগুলো পাস হবে।

দেশ যখন অর্থনীতিসহ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন কেন? এমন প্রশ্ন রেখে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন নিয়ে এখন দেখি অনেকেই সোচ্চার! যেসব দেশ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তাদের উদ্দেশে আমার প্রশ্ন- ’৭৫-পরবর্তী যখন একের পর এক নির্বাচনের প্রহসন হলো, বিএনপির আমলে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচনের নামে প্রহসনের চেষ্টা করা হলো- তখন তাদের বিবেক কোথায় ছিল? তখন কেন তাদের এই বিবেক নাড়া দেয়নি?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে যতগুলো নির্বাচন, উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে- প্রতিটি নির্বাচন স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এর আগে কখন হয়েছে? যে দেশগুলো নির্বাচন নিয়ে কথা বলে, তাদের একটি দেশের বিরোধী দল তো এখনো নির্বাচন মেনেই নেয়নি। অথচ তাদের মুখেই এখন নির্বাচন নিয়ে সবক শুনতে হয়। তিনি বলেন, দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদের তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর নামই সবচেয়ে বেশি। আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার, মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি।

এ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করেছে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনের যতটুকু সংস্কারের দাবি আওয়ামী লীগ করেছে এবং ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার যতই খারাপ কাজ করুক, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবস্থার মতো কিছু ভালো কাজ করে গেছে।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্য ও নির্বাচন ঠেকানোর নামে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাসের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাজোটগতভাবে অংশ নেয়। আর বিএনপি ২০-দলীয় জোট নিয়ে নির্বাচন করে সেখানে মাত্র ২৯টি আসন পায়। আর আমরা মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই। এর আগে নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি দেশে কী করেছে? ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর নামে সারা দেশে ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাস করেছে, ৫ শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, ৩ হাজার ৮২৫টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে, লঞ্চ-ট্রেন, সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ পুড়িয়ে দিয়েছে। অগ্নিসন্ত্রাসের মহোৎসব চালিয়েছে। জনগণ তাদের সেই নৈরাজ্য মেনে নেয়নি। জনগণ তাদের অগ্নিসন্ত্রাস মোকাবিলা করে ২০১৪ সালের নির্বাচন করেছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা তুলে ধরে সংসদ নেতা বলেন, ওই নির্বাচনের আগে আমি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি। বিএনপি ওই নির্বাচনে আসে মনোনয়ন বাণিজ্য করতে। ৩০০ আসনে তারা (বিএনপি) ৭০০ জনকে নমিনেশন দেয়। বিপুল টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য করে নির্বাচনের দিন সরে আসে। আর ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রিতে রাজি হইনি বলে আমাদের খেসারত দিতে হয়েছে। নির্বাচনে আমাদের হারানো হয়েছে। আমার কাছে দেশের জনগণের স্বার্থ সবার আগে। জনগণের সম্পদ জনগণের কাছে থাকবে- এটা স্পষ্ট করে বলেছি। এর কারণে আমাকে ওই নির্বাচনে খেসারত দিতে হয়েছে। আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অগ্রগতি সূচনা হয়েছিল সেটাও স্থবির হয়ে গিয়েছিল। জনগনের কোনো অধিকার বলে কিছু ছিল না। তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। বেঁচে থাকাই ছিল কষ্টকর। আমরা দেখেছি ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার রেখে নির্বাচনী প্রহসন। নির্বাচনের পর ৪৮ ঘণ্টা ভোটের ফল বন্ধ রেখে মন মতো করে ফলাফল প্রকাশ করতে দেখেছি।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে সরকারে আসতে পারিনি। কারণটা ছিল কিছুই না। নিজের দেশের গ্যাস বিক্রি করব না এই সিদ্ধান্তটাই ছিল আমার ভাগ্য নিয়ে খেলা। আমি সেটা পরোয়া করিনি। আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থটাই বড়। বাংলাদেশের সম্পদ বাংলাদেশের জনগণের কাছে থাকবে। জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগবে। এটা ছিল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যাহোক খেসারত দিতে হয়েছে। ক্ষমতায় আসতে পারিনি। কিন্তু এরপর দেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নির্যাতন অত্যাচার ছিল প্রতিনিয়ত ব্যাপার। এরপর ভোট চুরি। ওই ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে আবার ভোট চুরির পাঁয়তারা। এই দুঃশাসনের ফলে জরুরি অবস্থা। এলো সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি ছিল। তারা আমাদের ওপর অত্যাচার করলেও আমাদের প্রস্তাবিত স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ছবিসহ ভোটার তালিকাটা করেছিল। ভোটের ব্যাপারে এই নিয়মটা মেনে নিয়েছিল। আমরা ২০০৮ সালে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়ে সরকারে আছি।

বিএনপির সময়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমরা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। তবে সময়ে সময়ে কিছু কিছু লোডশেডিং করতে হয়। আর লোডশেডিং মাঝে মাঝে থাকাটা ভালো। কারণ কী অবস্থায় ছিল, ভুলে যায় তো, তাই মনে করায়ে দেওয়ার দরকার আছে মাঝে মাঝে। সেই জন্য আমি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে বলি একটু লোডশেডিং দিলে মানুষের মনে আবার আসবে.. আমরা এ জায়গায় ছিলাম, এই জায়গায় যাচ্ছি, এটা মনে করায় দেওয়া উচিত।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে কিছু মানুষ কষ্টে আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিনিসের কিন্তু অভাব নেই। উৎপাদনে ঘাটতি নেই। উৎপাদনের জন্য যা যা দরকার সেটা করছি। বাজারে গেলে কোনো জিনিসের অভাব নেই, মনে হয় কৃত্রিম উপায়ে মূল্য বাড়ানো হয়, ইচ্ছা করে বাড়ানো হয়। অনেক সময় গোডাউনে রেখে দিয়ে কেউ কেউ এরকম খেলা খেলে। সরকার পদক্ষেপ নিলে কমে আসে।

বাণিজ্যমন্ত্রীকে বাজার মনিটরিং করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাকে বলেছি বিশেষভাবে দেখার জন্য, কেন জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। কৃষককে উৎপাদন খরচ দিতে হবে উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি যেন না হয় সেই ব্যবস্থা নিয়েছি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছি। ধীরে ধীরে সেটা বাড়ানো হচ্ছে। টাকা ছাপানো হচ্ছে না। অনেকেই বলছে টাকা ছাপিয়ে টাকা ছড়ানো হচ্ছে। টাকা ছাপানো একদম বন্ধ করে দিয়েছি। টাকা ছাপানো হবে না। এ ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন তিনি।

ডলার সংকট দূর করার জন্য সরকারের গৃহীত কার্যক্রম তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ডলার বিনিময় হার যাতে নমনীয় থাকে সেই পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন ইচ্ছামতো এলসি খোলা যায় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সরকারপ্রধান বলেন, এখন যাচাই করে এলসি খোলা হয়। আগে যেমন ইচ্ছামতো কোনোটা অতিমূল্য, কোনোটা অবমূল্যায়ন করা হতো। সেটার আর সুযোগ নেই। এতে হয়তো কিছু ব্যবসায়ী বিপদে পড়ে যান। সেটা সঠিক বিপদ না, টাকা পাচারের সুযোগ কমে যায়। সেই জন্য কিছু চিৎকার কিছুদিন শুনেছি। কিন্তু বাস্তব কথা হলো অতিমূল্য দেখিয়ে কম মূল্যের জিনিস নিয়ে এসে, বাকি টাকা রেখে এসে একটা খেলা খেলা, সেটা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক একটা বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ব্লুমবার্গের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে এলসি খোলা হচ্ছে। এতে আমদানিতে যে অতিরিক্ত ব্যয় হতো সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। তার হিসাব কিন্তু আছে। এতে ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। খোলা বাজারে ডলার কেনাবেচার বিষয়ে সরকার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, নিত্যপণ্য আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে টাকা দিচ্ছি। দেশের মানুষের কষ্ট যেন না হয়। রিজার্ভ মানে হলো তিন মাসের আমদানির খরচ যাতে থাকে। তার বেশি খুব বেশি প্রয়োজন আছে তাও না। জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন শূন্য রিজার্ভ দিয়ে। তখনতো একটাও রিজার্ভ ছিল না। সাড়ে তিন বছরে দেশ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ছিল না। কয়েক মিলিয়ন ছিল বলেও উল্লেখ করে তিনি। কাজেই এটা নিয়ে কাউকে দুশ্চিন্তা বা মাথা খারাপ করার প্রয়োজন মনে করি না। ডলারের ওপর চাপ কমাতে ভারতের সঙ্গে লেনদেনে নিজস্ব অর্থে কেনাবেচার চুক্তি করা হয়েছে বলে জানান সরকারপ্রধান। এতে ডলারের ওপর চাপ কমে যাবে।

সর্বশেষ খবর