সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আসামির স্ত্রীর কাছে ঘুষ চেয়ে ওসি প্রত্যাহার

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

গৃহবধূর কাছে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবির অডিও ভাইরালের পর রাজশাহীর চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যার পর ওসির ঘুষ দাবির একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপর রাতেই তাকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করার আদেশ জারি করেন পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান। রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, প্রাথমিক তদন্ত করে শনিবার রাতেই চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। রবিবার তাকে পুলিশ লাইনে রিপোর্ট করতে বলা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে নিজের কোয়ার্টারের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগম (২৮) নামের ওই গৃহবধূর কাছে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম। এ ঘটনার পর থেকে ভয়ে বাড়িছাড়া ওই গৃহবধূ। এ বিষয়ে গত শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ওই গৃহবধূ। অভিযোগের অনুলিপির সঙ্গে ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের ওসির একটি অডিও রেকর্ড পাঠানো হয়। গৃহবধূ সাহারা বেগম চারঘাট থানার চামটা গ্রামের আবদুল আলিম কালুর স্ত্রী। কালু বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে আছেন। আবদুল আলিম কালু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এতে স্থানীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এর জেরে মাদক মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করা হয় বলে সাহারা বেগম অভিযোগ করেছেন।

১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদাবাজির অভিযোগ করতে গেলে গৃহবধূ সাহারা বেগম ও তার ছেলে রাব্বিকে নিজের শয়নকক্ষে ডেকে নেন ওসি মাহবুবুল আলম। প্রথমে তাদের কাছ থেকে ওসি মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। এরপর কথা বলতে শুরু করেন ওসি। ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্দা থেকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না।’ এরপর চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার জন্য জেলা ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারের সমালোচনা করেন। বলেন, ২ লাখ টাকা দেন কালকেই ডিবির ওসিকে বদলি করে দিব (আবদুল আলিম কালুকে পরিদর্শক আতিকুর রেজা গ্রেফতার করেছিলেন)।

এরপর গৃহবধূ সাহারা বেগমকে ওসি বলেন, ‘আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে গেছে (ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিল)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার নিচে ছাড়াতে পারবেন না। এরপর ওসি বলেন, এখনো তোমার গায়ে আঁচড় দিইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছো। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সেরকম সময় নয় যে, কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে, পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারের এখন কী কী লাগবে ৫ লাখ টাকা, ৭ লাখ টাকা লাগবে। আমি বলেছি আমি চেষ্টা করব। স্যারকে বলেছি এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই।’

ওসি আরও বলেন, মুক্তা (চারঘাটের মাদক সম্রাট নামে পরিচিত) অ্যাকশন নিতে পারবে না, শুভ (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবে না। তোমরা ৫ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দিব। থাকি না থাকি, ওদের সাইজ করব। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে। জেলা ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারের সমালোচনা করে অডিওতে ওসিকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারব না। কথা সব ভেঙে বলব না। কথা সব হয়ে গেল; যদি আতিকের বদলি চাও ২ লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে। যে জায়গার ক্ষমতা সেখানেই। ৫ লাখ আর ২ লাখ ৭ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দিব। আমার সব উপরের লাইন। যে টাকা দিবা এই টাকাই উপরে কাজ করবে।’ অডিওতে গৃহবধূ সাহারা বেগমের সুন্দর চেহারা নিয়েও মন্তব্য করতে শোনা যায় ওসিকে। সাহারা বেগম বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করে। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক র‌্যাব-পুলিশ আটক করেছে। এ ছাড়াও গত নির্বাচনে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করে। এরপর থেকে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করায় তারা। সাহারা বেগম বলেন, চারঘাটের চামটা গ্রামের আনজুর ছেলে মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাইমুদ্দিনের ছেলে সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। একই সঙ্গে টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই অভিযোগ করতে থানায় গেলে ওসি ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলে। তাতে আমি রাজি না হলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সকালে চারঘাট থানা ছেড়ে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত হয়েছেন পরিদর্শক মাহবুবুল আলম। তার সরকারি নম্বরটি ব্যবহার করছেন পরিদর্শক (তদন্ত) আফজাল হোসেন। পরিদর্শক মাহবুবুল আলমের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ খবর