শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
ইনস্টাগ্রাম টেলিগ্রাম হ্যাক-ক্লোন

ভয়ংকর ব্ল্যাকমেলিং চক্র

♦ সন্দেহভাজন ৯২ ফ্রিল্যান্সারকে চিহ্নিত করেছে সিআইডি ♦ সিম ক্লোন করে হ্যাক করছে ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ ♦ দ্রুত অর্থ উপার্জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অপরাধে ♦ অনেকেই জড়িত হচ্ছেন মানি লন্ডারিংয়েও

জিন্নাতুন নূর

ভয়ংকর ব্ল্যাকমেলিং চক্র

মেসেজিং প্ল্যাটফরম (টেলিগ্রাম) অ্যাপে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ছবি শেয়ারের অ্যাপ-ইনস্টাগ্রামের আইডি হ্যাক করে ভুক্তভোগীদের ভয়ংকরভাবে ব্ল্যাকমেল করছে সংঘবদ্ধ চক্র। প্রতারক চক্রের কথা না শুনলে কিংবা প্রতিশোধ নিতে ভয়ংকর এই চক্র ভার্চুয়াল দুনিয়ায় একজন ব্যক্তির ইমেজ ও সামাজিক অবস্থানের ক্ষতি করছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে এই প্রতারকরা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চলতি বছরের মাঝামাঝিতে এ ধরনের একটি চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। ভয়ংকর এই চক্র টেলিগ্রামে গ্রুপ খুলে সেখানে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও আপলোড করত। মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সাবস্ক্রাইবাররা এই গ্রুপের সদস্য হয়। আবার সিম ক্লোন করে প্রতারকরা এখন আর শুধু হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, তারা ভুক্তভোগীর ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করছে। এর মাধ্যমে মেসেজিং অ্যাপ আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবাও নিজেদের দখলে নিচ্ছে তারা। আশঙ্কা করা হচ্ছে- শুধু ব্ল্যাকমেইলিং নয়, এই চক্রের সদস্যরা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গেও জড়িত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কম অর্থ বিনিয়োগ করে এবং দ্রুত সময়ে বেশি অর্থ উপার্জনের নেশায় এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সিআইডির দেওয়া তথ্যে, এ ধরনের অপরাধে দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীসহ বেসরকারি চাকরিজীবীরা জড়িত। কয়েক মাস আগে এক অভিযানে টেলিগ্রাম গ্রুপে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়। এরা প্রযুক্তিগত বিষয়ে দক্ষ এবং বিদেশি তরুণীদের সঙ্গে সাবলীলভাবে আড্ডা দিতে পারত। এই চক্রের গ্রেফতারকৃত দুই সদস্যের পেজ ও অ্যাপস ঘেঁটে প্রায় ৯২ জন ফ্রিল্যান্সারকে চিহ্নিত করা হয়, যারা ভয়ংকর প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এ জন্য গত ১৬ মে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। এসব অ্যাডাল্ট গ্রুপের অ্যাডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করেন। পুলিশের ধারণা, টেলিগ্রাম গ্রুপের সদস্যরা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গেও জড়িত। জানা যায়, টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশের অনেক ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। এসব দেশের নাগরিকরা উঠতি বয়সের মেয়েদের (১২-১৮ বছর) আপত্তিকর কনটেন্ট কিনে তা সংরক্ষণ করত। আর এভাবে এই ভয়ংকর চক্র দেশে-বিদেশে প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। সাধারণত রাত জেগে এই চক্র প্রতারণার কাজ করে। প্রথমে এই চক্রের সদস্যরা নিজেদের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে নিজের চটকদার ছবি ও ভিডিও আপলোড করে তরুণীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। এতে অনেক তরুণী তাদের ফাঁদে পা দেয়। পরে এক পর্যায়ে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে। পাশাপাশি সমাজের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিদের নামেও নকল অ্যাকাউন্ট খুলে চলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কারবার। তবে এরা নিজেদের তথ্য গোপন রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে নিজের আইডিতে তারা ভুল ঠিকানা ও ছদ্মনাম ব্যবহার করে। জানা যায়, এই চক্রে জড়িতরা নগদ অর্থের পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করে। এর ফলে দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির বড় একটি চক্র গড়ে উঠেছে। যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই অপরাধীরা নতুন কনটেন্ট পেতে নকল এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্লোন করা সিম দিয়ে (মোবাইল নম্বর) এসএমএস বা কল-লগ অথেনটিকেশন নির্ভর যে কারও ফেসবুক আইডি ও ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি হ্যাক করা সম্ভব। এর মাধ্যমে মেসেজিং অ্যাপ আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা দখলে নিতে পারবে প্রতারকরা। এরই মধ্যে ছবি শেয়ারের অ্যাপ ইনস্টাগ্রামে ত্রুটি ধরা পড়ে। বলা হচ্ছে ক্লোন করা সিম দিয়ে ইনস্টাগ্রামের দখল নেওয়া যাবে। ফলে সিম ক্লোন করে প্রতারকরা এখন আর শুধু হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবা তথা মেসেজিং অ্যাপসের ওপরও নজর রাখছে। সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টেলিগ্রাম-ইনস্টাগ্রামের মতো অ্যাপগুলো যারা হ্যাক করে প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে। এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিয়েছি। দেশে যতগুলো অনলাইনভিত্তিক প্রতারণা হচ্ছে তার সবগুলোর ওপর আমাদের নজরদারি চলমান আছে। সাধারণত যারা স্বল্প টাকা বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা করতে চায় তারাই এসব অপরাধে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কম অর্থ বিনিয়োগ করে দ্রুত সময়ে বেশি অর্থ উপার্জনের নেশায় এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সিআইডি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণীদের আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস করে ব্ল্যাকমেইলিং এবং এসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত চক্রের মূলহোতাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। কক্সবাজার ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার গ্রেফতার করে। এদের কাছে বিভিন্ন ব্যক্তির টেলিগ্রাম আইডিসহ অসংখ্য টেলিগ্রাম গ্রুপ, বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেলের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের কয়েক হাজার ন্যুড ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায়। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই হাজার হাজার তরুণীকে ব্ল্যাকমেল করে আসছিল। তারা তরুণীদের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে গোপন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখাত। পরে তারা ভুক্তভোগীদের ব্ল্যাকমেল করে অর্থ দাবি করত। অর্থ দিতে না পারলে সেই তরুণীদের ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করত। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিত। গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করত তা নয়, চক্রটি ওসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করত। জানা যায়, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবার্গ নামের এক ব্যক্তি। যার আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম চট্টগ্রামে থাকতেন। ২০ বছর বয়সী সায়েম শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সায়েমের কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, মার্ক-সাকারবার্গ ও তার সহযোগী গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোর সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া ৪ লাখ। এগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও ও প্রায় ৩০ হাজার কনটেন্ট রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর