বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আদালতে দিন কাটে বিএনপি নেতাদের

এক মামলায় হাজিরা, আরেক মামলায় সাক্ষ্য

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

আদালতে দিন কাটে বিএনপি নেতাদের

সুলতান সালাউদিন টুকু। বিএনপির যুব সংগঠন যুবদল সভাপতি। এক মামলায় হাজিরা, আরেক মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ। তার ওপর রয়েছে জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর ভয়। ছুটির দিন ছাড়া এভাবে প্রায় দিনই যেতে হয় আদালতে। ৩২৫ মামলা মাথায় নিয়ে মাসের পর মাস চলছে তার দিন। আবার এরই মধ্যে যুবদলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু সুলতান সালাউদ্দিন টুকু নন, তার মতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে আসেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৪৫০। প্রায় একইভাবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ তৃণমূলের এরকম হাজার হাজার নেতা-কর্মী দিন কাটে এখন আদালতে। নেতাদের অভিযোগ, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য করার লক্ষ্যেই এ সব মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নেতারা। এর সঙ্গে রয়েছে আন্দোলনে সক্রিয় নেতাদের নিষ্ক্রিয় রাখার কৌশল। বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ বিষয়ে বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো রাজনৈতিক ও ভিত্তিহীন। আদালত যেভাবে এই মামলাগুলো পরিচালনা করছেন মনে হচ্ছে ‘সুপারসনিক’। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি হয়নি। কখনো রাতে, কখনো মোমবাতি জ্বালিয়ে সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। বিচারের নামে হচ্ছে বিচারিক হয়রানি। তিনি বলেন, নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের আদালত এখন বিরোধী দল-মত নিয়ন্ত্রণ এবং হয়রানি করার ভয়ংকররূপ ধারণ করেছে।

জানা যায়, বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪২ লাখের ওপরে। ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার গায়েবি মামলা দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আবারও নামমাত্র নির্বাচন করতে আদালতকে ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের সাজা দিতে উঠে-পড়ে লেগেছে সরকার। বিএনপি নেতাদের আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার অভিযোগে করা সাজানো মামলাগুলোর বিচার দ্রুত এগোচ্ছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা দেওয়া হয়। ওইসব মামলার অনেকগুলো এখন বিচারের পর্যায়ে রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও মহাসচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই মামলার আসামি। চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে ৩৫টি মামলা চলমান। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কয়েকটি মামলায় আগেই সাজা প্রদান করা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৯৮টি। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মির্জা আব্বাসের মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে করা মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এ সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় খন্দকার মোশাররফের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ হয়েছে। সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হলেই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে যাবে। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বিচারাধীন। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বেগম সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। বাস পোড়ানোর একটি মামলায় সম্প্রতি অভিযোগ গঠন হয়েছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিচার চলছে। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা শেষ পর্যায়ে আছে। স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ (আমান) ইতোমধ্যে একটি মামলায় ১৩ বছরের দন্ডপ্রাপ্ত। ইকবাল হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সম্প্রতি।

খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের ২৫টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ দ্রুতগতিতে চলছে। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই তাকে আদালতে হাজির হতে হয়। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪৪টি মামলা, এর মধ্যে ১০টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ছবির বিরুদ্ধে রয়েছে সাতটি মামলা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা চলমান। একই কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের বিরুদ্ধে মামলা ১২৭টি। তানভীরের বাবা সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আছে ১৫০টি মামলা। এর মধ্যে ৬০টিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। পিতা-পুত্র দুজনই কারাগারে রয়েছেন। সেখান থেকেই নিয়মিত আদালতে হাজির করা হচ্ছে। মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, একইভাবে প্রায় প্রতি কর্মদিবসে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ২৫০টি মামলা। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুর বিরুদ্ধে ২২৬টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী ১৭০টি, সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান ১৪৬টি, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল ১৫০টি, আকরামুল হাসান ১৪৬টি, হাবিবুর রশীদ হাবিব ১০৩টি, বজলুল করিম চৌধুরী ৯৫টি, মামুন হাসান ২০০টি, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল ১১০টি, আনিসুর রহমান তালুকদার ২১১টি, ছাত্রদলের সাইফ মোহাম্মদ জুয়েল ১০৬টি মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত চলছে বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর