শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরমাণু যুগে বাংলাদেশ

সাড়ে ছয় বছরে প্রথম ইউনিট নির্মাণের অনন্য রেকর্ড ♦ পরীক্ষামূলক উৎপাদন ২০২৪-এর সেপ্টেম্বর ♦ বাণিজ্যিক উৎপাদন ২০২৫ সালে

জিন্নাতুন নূর, ঈশ্বরদী থেকে

পরমাণু যুগে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ হবে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। বহু প্রতীক্ষার পর একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবশেষে তার যাত্রা করছে। আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম গর্বিত সদস্য হিসেবে। আজ পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জড়িত রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক আলেস্কি লিখাচেভ উপস্থিত থেকে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবেন। বাংলাদেশের পক্ষে ইউরেনিয়াম গ্রহণ করবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। গতকাল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায় ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে রূপপুরজুড়ে সাজ সাজ রব। এ উপলক্ষে প্রকল্প এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। আশপাশ এলাকায় টাঙানো হয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন। প্রকল্পকাজে জড়িত রাশিয়ানদের আবাসস্থল রূপপুরের গ্রিন সিটিকে সুন্দর দেয়াল অঙ্কনে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান সফল করতে রূপপুরে অবস্থান করছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও রাশিয়ার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সাত বছর এই দিনের অপেক্ষা করেছি। এই সময় নিরলসভাবে প্রকল্পের নির্মাণকাজে জড়িতরা কাজ করেছেন। করোনাকালেও প্রকল্পের কাজ এক দিনের জন্যও পিছিয়ে পড়েনি। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের প্রকল্প এত দ্রুত সময়ে শেষ হয়নি। যেখানে আমরা সাত থেকে আট বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে পেরেছি, অন্যদের সেখানে ১০ থেকে ১২ বছর লেগেছে। এটি এমন একটি সময় যখন বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ আইএইএ’র বোর্ড অব গভর্ন্যান্সেও যুক্ত হয়েছে। সঞ্চালন লাইন ও অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষা মিলিয়ে প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে আরও দেড় বছর লাগতে পারে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতে উত্তরবঙ্গের মানুষ যাতে উপকৃত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অনেক দেশ হতবাক। জিডিপিতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ২% অবদান রাখবে। এ ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও রাশিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আর কোনো উদ্বেগ নেই।’

রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, ‘পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কতগুলো গাইডলাইন মেনে আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হয়। এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটটি নির্মাণের যে মহাযজ্ঞ তা আজ চূড়ান্ত ধাপে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রকল্প এলাকায় পারমাণবিক জ্বালানি এসে গেছে এবং আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ মেনে এ জ্বালানি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। আমাদের প্রশিক্ষিত জনবলের মাধ্যমে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা তা সংরক্ষণ করছি। পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সব বিধিনিষেধ মেনেই জাতি জ্বালানি সংরক্ষণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা প্রকল্প এলাকাকে এখন পারমাণবিক স্থাপনায় উন্নীত করেছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আজ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাওয়ার জন্য আমরা অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। আশা করছি সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউরেনিয়াম আসার মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক জ্বালানির মালিক হলো। আর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রূপান্তরিত হলো। পারমাণবিক ক্লাবে পদার্পণের জন্য জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত।’

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আমরা ইউরেনিয়াম সংরক্ষণের সক্ষমতা অর্জন করেছি কি না তা পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা যেখানে জ্বালানি সংরক্ষণ করছি তাকে বলা হয় মেটাল ব্যালান্স এরিয়া। সেখানে আমরা কী পরিমাণ জ্বালানি এনেছি তা পরিমাপ করে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। নিউক্লিয়ার প্রকল্পে একটি ধাপ থেকে আরেকটি ধাপে যাওয়ার আগে পূর্ববর্তী ধাপে সব ঠিক আছে কি না তা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করব।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজে যে অগ্রগতি তা সন্তোষজনক। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার দুই বছর পর রাশিয়া সরকারকে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কিস্তির অর্থ দেওয়া শুরু করবে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য এখনো নির্ধারিত হয়নি। তা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। তবে দেশের বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্যের চেয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের মূল্য কম হবে।

নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হতে ১০ মাসের মতো লাগতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের কাজ ৯০% আর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ ৭০% শেষ হয়েছে।

জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরে আরও দুটি ইউনিট নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে দক্ষিণবঙ্গে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরি করতে গিয়ে আটটি ধাপে রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স মেনটেইন করতে হয়েছে। সে হিসেবে প্রতিটি ধাপেই প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হচ্ছে। প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ চূড়ান্ত ধাপে নিতে লেগেছে সাড়ে ছয় বছর। রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ে ইউরেনিয়াম ঢোকানোর আগে সব পারিপার্শ্বিক অবস্থা ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষানিরীক্ষা করেই জ্বালানি ঢোকানো হবে। এখন রূপপুর কর্তৃপক্ষ ফুয়েল লোডিংয়ের বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রথম সুইচিং থেকেই বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত জনবল এর সঙ্গে কাজ করছে। ফলে যেদিন বাংলাদেশ রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বুঝে নেবে তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে এ প্রকল্প পরিচালনা করতে এত বিশালসংখ্যক বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন আছে কি না। প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য দেশি দক্ষ জনবলকে এরই মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যে ইউরেনিয়াম এসেছে তার আনলোডিং থেকে শুরু করে পরীক্ষানিরীক্ষা ও সংরক্ষণ সবকিছু বাংলাদেশি জনবল করছে।

২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে যে গ্রিড লাগবে তা রূপপুর প্রকল্প থেকেই শুরু হবে। অর্থাৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অবকাঠামো তৈরি করছে। এখান থেকে ডেডিকেটেড রেলওয়ে কমিউনিকেশনও তৈরি হবে।

জানা যায়, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইউরেনিয়ামের চালান ধাপে ধাপে আসবে। জ্বালানির চালান প্রতি সপ্তাহে আসবে। প্রথম চালানের জ্বালানি আসার পর সব ধরনের মেজারমেন্ট এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ জ্বালানি আসার আগে ডামি ফুয়েল ব্যবহার করে তা সংরক্ষণ করে এ প্রকল্পের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য কোন লাইনগুলো আগে আসবে তা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এ কাজগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনিটর করা হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা আরও জানান, পিজিসিবি, বিটিসিএলসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করলে নির্ধারিত সময়েই এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসতে পারবে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, কোনো অবস্থায়ই এর রেডিয়েশন দ্বারা সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেডিয়েশন মনিটরিং এরিয়া হচ্ছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার। কেন্দ্রটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা যে কোনো কারণেই হোক না কেন, তা থেকে কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। নিরাপত্তার বিষয়গুলো এমনভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, এখানে কোনো একটি সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য আরেকটি সিস্টেম চালু হয়ে যাবে। এ কেন্দ্রের রেডিয়েশন যে মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না তা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প এলাকায় ২৩টি মনিটরিং স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। যেদিন ইউরেনিয়াম লোড করা হবে তার আগেই মানুষকে জানানো হবে সেদিন পরিবেশে রেডিয়েশনের মাত্রা কত। মানুষের আশঙ্কা দূর করার জন্য অটোমেটেড রেডিয়েশন মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হবে। এজন্য যে নকশা করা হয়েছে তাতে প্রকল্প এলাকার পরে আর মনিটরিংয়ের প্রয়োজন হবে না। এ প্রকল্প এলাকার সীমানাপ্রাচীরের বাইরে সাধারণ মানুষ এখন যেমন ভাবে বসবাস করছেন, সেভাবেই তারা কোনো ক্ষতি ছাড়া থাকতে পারবেন।

এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রূপপুরে নেওয়া হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানি ইউরেনিয়াম। রাশিয়ার একটি কারখানা থেকে একটি বিশেষ বিমানে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পারমাণবিক জ্বালানির এ চালান আনা হয়। রাশিয়ার নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেনট্রেটস প্লান্টে (এনসিসিপি) এ জ্বালানি উৎপাদিত হয়। রূপপুরের জ্বালানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চুক্তিবদ্ধ রয়েছে রোসাটম। রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় নির্মাণ করা হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই ইউনিটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর ৯০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে রাশিয়া।

সর্বশেষ খবর