শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরমাণু যুগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা

বাংলাদেশ রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু : পুতিন ♦ শান্তি রক্ষায় পরমাণু শক্তি ব্যবহার হবে : শেখ হাসিনা

জিন্নাতুন নূর, ঈশ্বরদী থেকে

পরমাণু যুগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন -পিআইডি

বাংলাদেশে পরমাণু যুগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিউক্লিয়ার ক্লাবের গর্বিত এক সদস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম ব্যাচের হস্তান্তর উপলক্ষে প্রকল্প এলাকায় এ গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর  বক্তব্যে বলেন, রাশিয়া শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে না। প্রকল্পের পুরো সময় বাংলাদেশকে সব ধরনের কারিগরি সহযোগিতা করে যাবে। এ প্রকল্প বাংলাদেশের বর্ধনশীল অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে। ভারতও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু। গত বছর বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফরের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়। রূপপুর প্রকল্পে সরাসরি ২০ হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া অন্য অনেক কোম্পানি এ প্রকল্পে কাজ করছে। তা-ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করবে। ২০২৬ সালে পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবে। এ কেন্দ্র জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাবে। ফলে দেশের পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। পুতিন আরও বলেন, রাশিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ করে যাবে। অবশ্যই এতে কার্বন নিঃসরণ কম হবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে যৌথভাবে ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এতে আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা সহযোগিতা করেছে। তাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখানে অত্যাধুনিক নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার, আইএইএ গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করব, পাশে থাকব এবং কারিগরি সহযোগিতা দেব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেন, পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সফল পরিণতি লাভ করেছে। আজ থেকে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের কাতারে শামিল হলো এবং বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলো। অচিরেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হবে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৬ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অচিরেই প্রথম ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পরমাণু শক্তি আমরা শান্তি রক্ষায় ব্যবহার করব। আমরা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের সাধারণ ও সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তির বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আমরা ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করেছি এবং একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। এ কর্তৃপক্ষ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্ধুপ্রতিম রাশান ফেডারেশনের সরকার এবং জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অসামান্য সহযোগিতা করেছিল এবং আমাদের এ স্বপ্নের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে মস্কোয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছি। এখন পর্যন্ত আপনার সর্বাত্মক সহযোগিতায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আমি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট ঢালাইয়ের উদ্বোধন করি। ২০২১ ও ২০২২-এ কেন্দ্রের যথাক্রমে ইউনিট-১ ও ইউনিট-২-এর রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপন করি। আজ এ কেন্দ্রে পারমাণবিক জ্বালানি সংযুক্ত হলো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলকে রাশান ফেডারেশন যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যেহেতু বন্ধুপ্রতিম ভারতেও একই রকম একটি প্রকল্প হচ্ছে, সেজন্য আমাদের কিছু জনবলকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাই। এজন্য তিনি মোদি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য আমরা পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছি। যে কোনো ধরনের দুর্যোগে আমাদের এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটা খেয়াল রেখে এ প্লান্টের ডিজাইন প্রণয়ন এবং নির্মাণকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তা ছাড়া ব্যবহৃত জ্বালানি (স্পেন্ট ফুয়েল) ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা রাশান ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। রাশান ফেডারেশন এসব স্পেন্ট ফুয়েল তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে আরও বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি। স্বাগত বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা (রোসাটম)-এর ডিজি আলেক্সি লিখাচেভ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানির প্রথম ব্যাচ হস্তান্তর সম্পর্কিত একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, আইএইএ’র গাইডলাইন মেনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ আজ নিউক্লিয়ার ক্লাবের নবীন ও গর্বিত এক সদস্য।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছি। পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের স্বপ্ন আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। আইএইএ’র ডিজি রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব নিরাপত্তাব্যবস্থা মেনেই কেন্দ্রটি যাতে নির্মিত হয় আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই। রোসাটমের ডিজি আলেক্সি লিখাচেভ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ। আগামী বছরের শেষ নাগাদ প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে আশাবাদী। এ প্রকল্পে প্রতিদিন ২৩ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন। এর মধ্যে ১৮ হাজারই বাংলাদেশের নাগরিক। আর ৪ হাজারের বেশি রুশ বিশেষজ্ঞ। এ প্রকল্প চালু হলে কম করে ২০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইফ সার্কেল ১০০ বছর হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, আজ জাতির জন্য অনন্য শুভদিন। এ এক অনন্য ইতিহাস, যার সাক্ষী হতে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। শতভাগ বাঙালির শুভকামনা ছিল বলেই এমন একটি দুরূহ কাজ আমরা শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে পেরেছি। এখানে স্বাধীনতাযুদ্ধের বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার আন্তরিকতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। একই সঙ্গে আমরা ভারতের সমর্থনও পেয়েছি। অনুষ্ঠানের শেষে পারমাণবিক জ্বালানির মডেল সুসজ্জিত একটি নৌকায় করে মঞ্চে নিয়ে আসে রাশিয়ার একটি দল। বাংলাদেশের পক্ষে আরেকটি দল তা গ্রহণ করে।

সর্বশেষ খবর