শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটের আগে বহুমুখী চাপ কর্মকর্তাদের

বিভিন্ন ক্যাডারের নানান দাবিদাওয়া, আদায়ে দেওয়া হচ্ছে কর্মসূচি

ওয়াজেদ হীরা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরছেন। পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে বহুমুখী চাপ দিচ্ছেন সরকারকে। অনেকেই বিভিন্ন কর্মসূচিতেও যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়গুলোয় পরিস্থিতি বুঝে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাবি পূরণও করা হচ্ছে। বিশেষ করে পদোন্নতির দাবিদাওয়াগুলো সরকার ধাপে ধাপে পূরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিলের আগেই পদোন্নতিসহ সব দাবিদাওয়া আদায় করতে চান কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, কিছু ক্যাডারে পদ না থাকলেও নিয়মিত পদোন্নতি হচ্ছে। আর কিছু ক্যাডারের পদোন্নতি নানা শর্তে আটকে যাচ্ছে। নিয়মিত পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা নির্বাচনের আগে তাঁদের প্রাপ্য আদায় করতে চান। প্রশাসন ক্যাডারে ইতোমধ্যে বড় পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। ২২১ কর্মকর্তা যুগ্মসচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব পদোন্নতি পান প্রশাসন ক্যাডারের ২৭০ কর্মকর্তা। এখন উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এখানেও কয়েক শ কর্মকর্তাকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। ফলে একই ব্যাচের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও নির্বাচনের আগে পদোন্নতির জন্য চেপে ধরেছেন। শিক্ষা, পুলিশ ক্যাডারসহ ননক্যাডারের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে তাদের দাবি নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দাবিদাওয়া যে-কেউ করতেই পারেন। যে কোনো পেশার লোকজন করতে পারেন, যে কোনো নাগরিক করতে পারেন। সরকার বিচারবিবেচনা করে দেখবে কী করা যায়। তাদের দাবিদাওয়া পূরণ করা যায় কি না পরীক্ষানিরীক্ষা করবে। বিশ্লেষণ করে দেখবে।’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, ‘ভোটের আগে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন না হলে নেবে না। ভোটের কারণে তো সরকারের কার্যক্রম থেমে থাকে না। কোন সিদ্ধান্ত কোন সময় নেওয়া সমীচীন তা সরকারই ভেবে দেখবে এবং সিদ্ধান্ত দেবে।’

শিক্ষা ক্যাডারদের দাবি : আন্তক্যাডার বৈষম্য, পদোন্নতি, পদসৃজনে জটিলতা নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে ইতোমধ্যে ২ অক্টোবর সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। দেশের সব সরকারি কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, আলিয়া মাদরাসা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর, শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দফতরে এ কর্মবিরতি পালন করা হয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ কর্মসূচি পালন করেছেন সবাই, দাফতরিক কাজ হয়নি। আমাদের সঙ্গে এখনো সংশ্লিষ্ট কারও যোগাযোগও হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর টানা তিন দিন কর্মবিরতি পালন করা হবে। ইতোমধ্যে ২৭ সেপ্টেম্বর সহযোগী অধ্যাপক পদে ৬৯০ জনের পদোন্নতি হয়েছে।’

পুলিশেও পদোন্নতির চাপ : পুলিশের বিভিন্ন স্তরেও পদোন্নতির চাপ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে পদোন্নতি না পেয়ে আইজিপির সঙ্গে দেখা করে ক্ষোভ জানিয়েছেন পুলিশ ক্যাডারের দুই ব্যাচের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ৩৫ ও ৩৬তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারের সদস্যরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই পদোন্নতি নিশ্চিত করতে আইজিপিকে অনুরোধ জানান। ৩৫তম ব্যাচের পুলিশ সদস্যরা প্রায় দেড় বছর ধরে পদোন্নতিবঞ্চিত। এ সময়ে তাঁদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ষষ্ঠ গ্রেডে) পদে পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল। ৩৬তম পুলিশ ক্যাডারের সদস্যরা ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতির জন্য বয়সসীমা, চাকরির মেয়াদসহ সব শর্ত পূরণ করেছেন। তাঁরাও এখনো পদোন্নতি পাননি। ৩৬ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দাবি আমরা বলেছি। আমাদের দাবিটা যৌক্তিক। সঠিক সময়ে পদোন্নতি না পেলে কাজে গতি নষ্ট হয়, অনেক সময় নিজেকে হেয় হতে হয়।’ ১৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পদোন্নতির দাবি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানার ওসিরা বৈঠক করেন। সেখানে সুপারনিউমারি (পদ না থাকলেও পদোন্নতি) পদোন্নতিসহ বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছেন ঢাকার ওসিরা। মন্ত্রী তাঁদের এসব দাবিদাওয়া লিখিত আকারে দিতে বলেন। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ওই বৈঠকের পরে জানান, মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তাঁরা পুলিশ ক্যাডারদের মতো ইন-সিটু প্রমোশনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতি দিয়ে আগের দায়িত্বেই বহাল রাখার দাবি করেছেন। এ ছাড়া ননক্যাডার নীতিমালা অনুযায়ী, নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতির দাবি করছেন তাঁরা। এ ছাড়া এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের র‌্যাংক ব্যাজের নীল/লাল ফিতা তুলে নেওয়া, এসআই ও ইন্সপেক্টর র‌্যাংক ব্যাজ উন্নীত করার বিষয়টির সুরাহা, কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট (পিএল) করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি পাবেন স্বাস্থ্য ক্যাডার, আন্দোলনে ইন্টার্ন নার্সেরা : স্বাস্থ্য ক্যাডারদের জন্য একটি বার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ৩১ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. শামিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য এখন থেকে অন্যান্য ক্যাডারের মতো আবেদন করতে হবে না। মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি পেয়ে যাবেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

অন্যান্য ক্যাডারেও আছে নানা বঞ্চনা : প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে দায়িত্ব পালন করা অনেক অধিদফতরে পদোন্নতিতে বঞ্চনা রয়েছে। সচিব সমমর্যাদার গ্রেড-১ পদ থাকলেও সেগুলো শূন্য আছে। পদোন্নতি বৈষম্যের কারণে অনেকেই ক্যাডার পরিবর্তন করছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ডিজি গ্রেড-১ পদ হলেও বর্তমান ডিজি চুক্তিতে দ্বিতীয় গ্রেডে আছেন, গ্রেড-১ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। কৃষি ক্যাডারের দ্বিতীয় গ্রেডের পদ অনেক খালি; কর্মকর্তারা পদোন্নতির আশায় দৌড়ঝাঁপ করছেন। সওজের প্রধান প্রকৌশলী গ্রেড-১ পদ, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর তিনটি পদ গ্রেড-২। কিন্তু চারটি পদই খালি। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী ১৮ ব্যাচের ক্যাডার তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা হয়ে আছেন। গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর গ্রেড-১ পদ হলেও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী তৃতীয় গ্রেডে রয়েছেন। একাধিক প্রকৌশলীর ভাষ্য, জনপ্রশাসন প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় প্রকৌশলীসহ সবার পদোন্নতি তাদের হাতে। নিজেরা পদ ছাড়াই শর্ত বদলে পদোন্নতি নিলেও অন্যদের ক্ষেত্রে নিয়োগবিধি, পদ খালি না থাকা, দুদকের ছাড়পত্র না থাকার কারণ দেখিয়ে আটকে দেন।

সর্বশেষ খবর