রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আধুনিক বিমানবন্দরের যুগ শুরু

আমরা কেন পিছিয়ে থাকব থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বিশেষ প্রতিনিধি

আধুনিক বিমানবন্দরের যুগ শুরু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন করেন -পিআইডি

আধুনিক বিমানবন্দরের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বেলা ১১টায় নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন এ টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে আগের থাকা দুটি টার্মিনালের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি যাত্রী সেবা পাবেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একসময় বাংলাদেশই হবে সারা বিশ্বের যোগাযোগের হাব। সেভাবেই আমরা গড়ে তুলছি। বিভিন্ন সময়ে আকাশপথে যোগাযোগের রুট পরিবর্তন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, একসময় আন্তর্জাতিক হাব ছিল হংকং। এরপর হলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড; এখন দুবাই। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক হাব। রিফুয়েলিংয়ের জন্য অনেকেই এখানে আসবে, থামবে; বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সি-বিচ, সেটাও সবাই উপভোগ করতে পারবে। সেভাবেই আমরা গড়ে তুলতে চাই।’ এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থার্ড টার্মিনালে এসে পৌঁছান। সেখানে তিনি শিশুদের সঙ্গে প্রথমে ছবি তোলেন এবং কথা বলেন। পরে টার্মিনালের করিডর ঘুরে দেখেন। বিমানবন্দরের প্রক্রিয়া অনুযায়ী, তিনি লাগেজ চেকিং করান, বোর্ডিং পাস নেন এবং যথারীতি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে কাউন্টার পার হন। পরে তিনি প্রি-বোর্ডিং সিকিউরিটি স্ক্যান করান এবং চলন্ত ওয়াকওয়ে পার হয়ে বোর্ডিং ব্রিজে যান। বিভিন্ন স্পটের আলোকচিত্রে বিমান ও বিমানবন্দরের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী এগুলো অবলোকন করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে নানা বিষয়ে ব্রিফ করেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। বিমানবন্দরের এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে থার্ড টার্মিনাল প্রাঙ্গণের অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীসহ উপস্থিত দর্শকবৃন্দ দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে ঠোঁট মেলান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, বিমান সচিব মোকাম্মেল হোসেন প্রমুখ।

পরে তৃতীয় টার্মিনাল, বিমান ও বিমানবন্দরের উন্নয়নের ওপর একটি ডকুমেন্টরি প্রদর্শন করা হয়। বেবিচকের কর্মকান্ডের ওপরও একটি ডকুমেন্টরি দেখানো হয়। অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিব হাসান, জাপান ও জাইকার প্রতিনিধি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন। মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রযুক্তি সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলে মানুষের যোগাযোগ সহজ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন সবকিছু উন্নত করার ব্যবস্থাই তাঁর সরকার করবে। ঝরঝরে বিমানের যুগ পেরিয়ে এখন বিমানের বহরে ২১টি অত্যাধুনিক বিমান যোগ হয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। তাছাড়া এই তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে আমাদের আড়াই হাজার নতুন পথ সৃষ্টি হবে।’ দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে সরকার বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে লালমনিরহাটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখি আমাদের আশপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়। তাই আমরা কেন পিছিয়ে থাকব, আমরাও চাঁদে যাব। ভবিষ্যতে সেভাবেই আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব।’ তিনি বলেন, আমরা আরও নতুন কিছু বিমান (উড়োজাহাজ) কিনব। এয়ারবাসের সঙ্গে এমওইউ সই হয়েছে। তারা আমাদের কিছু ঋণও দেবে। আন্তজেলায় বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা আমার আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শাহজালালে ভবিষ্যতে যাত্রী বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নতুন রানওয়ে করার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। কক্সবাজারে সমুদ্রের পানি ঘেঁষে বিমান ওঠানামা করবে সেটি তাঁর প্রবল ইচ্ছা ছিল। সেভাবেই কক্সবাজারের রানওয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসি তখন বিমানবন্দরে কোনো বোর্ডিং ব্রিজ বা পার্কিং লট; কিছুই ছিল না। তাই তখন থেকেই আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম এই বিমানবন্দরের উন্নয়ন করব। একই সময়ে চট্টগ্রাম এবং সিলেট দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও আমরা নির্মাণ করি। সেই সঙ্গে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়নের গ্রকল্প গ্রহণ করি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল, এই সময়েই কিন্তু এই বিমানবন্দর উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেন, আমাদের বিমানবন্দরগুলোকে আরও আধুনিক এবং যাতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। কারণ, আমাদের দেশের অনেক লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করে। তারা বিভিন্ন দেশে কাজ করে, আমাদের জন্য রেমিট্যান্স পাঠায়। তারাও যাতায়াত করে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। সেই সঙ্গে আমাদের বঙ্গোপসাগর এই তিন রুটের মাঝে। প্রাচীন যুগ থেকেই এই জায়গাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এই টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী। তবে এটা প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’ বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, স্বপ্নের চেয়েও বড় এই প্রকল্প। আজ আমাদের গর্বের দিন। আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। অনেক বাধা আমাদের পার হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তিনটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো মেনে তৃতীয় টার্মিনাল স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্থাপত্যশৈলী ও গুণগত মানের দিক দিয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। 

তৃতীয় টার্মিনাল সম্পর্কে কিছু তথ্য : বেবিচক জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল তিন তলাবিশিষ্ট। টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা হবে বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি।

বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ছয়টি চ্যানেল থাকবে। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি। ভিভিআইপি ৩টি। প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল দুটির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনো সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডর নির্মাণ করা হবে। তিন তলাবিশিষ্ট থার্ড টার্মিনালের প্রথম তলায় ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। সেখানে ভিভিআইপি, ভিআইপিদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যান্টিন এবং বোর্ডিং ব্রিজ। তৃতীয় তলায় বিদেশ থেকে আসা এবং বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক ইন কাউন্টার, সিকিউরিটি সিস্টেম রয়েছে। থার্ড টার্মিনালে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ ব্যবস্থাপনা থাকবে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে এ আয়োজন।

সর্বশেষ খবর