রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রক্তাক্ত ফিলিস্তিন নিহত ৪৩২

হামাসের হামলায় নিহত ২০০ ইসরায়েলি ♦ পাল্টা হামলায় নিহত ২৩২ ফিলিস্তিনি ♦ যুদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের

প্রতিদিন ডেস্ক

রক্তাক্ত ফিলিস্তিন নিহত ৪৩২

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে গতকাল ভোরে ইসরায়েলের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তাদের ছোড়া হাজার হাজার রকেটে ইসরায়েলের আকাশ ঢেকে যায়। হামাস ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। এতে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ইসরায়েলি ভূখন্ডের অংশগুলো। এর পাল্টা হিসেবে ইসরায়েলি বাহিনী স্থল ও আকাশ পথে গাজায় অভিযান চালিয়ে ২৩২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, গাজার ওপর ইরসায়েলি বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছিল। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, পার্স টুডে, এএফপি।

সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১৯৮ ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১ হাজার ৬১০ জন। ফিলিস্তিনিরা দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আল-আকসার তুফান’ নামক অভিযান চালানোর পর ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী আকাশ থেকে একাধারে বোমা ফেলছে। এর ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর রেডিও জানিয়েছে, শনিবার ভোর থেকে এ পর্যন্ত সামরিক-বেসামরিক ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত ও ১ হাজার ১৬০ জন ইসরায়েলি আহত হয়েছে।

আরেক খবরে বলা হয়েছে, ভোর বেলা হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযানে অন্তত ৪০ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং ৩ শতাধিক আহত হয়েছে। স্থল, আকাশ এবং সমুদ্র থেকে একযোগে ওই অভিযান চালানো হয়েছে। হামাস ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ২০ মিনিটে ৫ হাজারের বেশি ক্ষেপণান্ত্র ও রকেট নিক্ষেপ করেছে। এই অভিযানে তারা বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সেনাকেও গ্রেফতার করেছে। ফিলিস্তিনি সূত্রের খবরে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে গাজা অঞ্চলের জন্য নিযুক্ত সাবেক প্রধান ইসরায়েলি সেনাকমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিমরোদ আলুনিও রয়েছেন। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, এই জেনারেলকে মাটির ওপর শোয়ানো অবস্থায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন হামাসের যোদ্ধারা। ফিলিস্তিনের গাজার সীমান্তের কাছেই ছিল তার বাসভবন। এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে মুক্ত করতে হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে হামাসের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণে যুক্ত সালেহ আল-আরওরি বলেছেন, ‘আমাদের অনেকে ইসরায়েলের কারাগারে রয়েছেন। আমরা যাদের আটক করেছি, তাদের বিনিময়ে আমাদের সব বন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে।’

হামাস যোদ্ধারা ইহুদি বসতি এলাকা ‘নাহাল ওজ’ দখল করে নিয়েছে। তারা অধিকৃত অঞ্চলের দক্ষিণে ইসরায়েলি সেনাদের একটি বিমান ঘাঁটিতে প্রবেশ করে তাদের বেশ কয়েকটি এফ-১৬ বোমারু বিমান দখল করে গাজায় স্থানান্তর করেছে। হামাস ইসরায়েলের সাতটি ইহুদি উপশহরের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে।

এর আগের খবরে বলা হয়েছিল, হামাসের নজিরবিহীন এই হামলায় কমপক্ষে ২২ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। আরেক খবরে বলা হয়, ৪০ জন ইসরায়েলি নিহত ও কমপক্ষে ৭৪০ জন আহত হয়েছে। এই ঘটনাকে ইসরায়েল তাদের বিরুদ্ধে হামাসের যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করে ‘পাল্টা যুদ্ধের ঘোষণা’ দিয়েছে। এ ব্যাপারে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে।

আরেক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, হামাসসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীরা হামলার প্রথম ২০ মিনিটে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছুড়েছে। ফলে ইসরায়েলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এ সময় অনেকেই ডাস্টবিনে আশ্রয় নেন। হামাস বলেছে, ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে নতুন অভিযানের অংশ হিসেবে রকেটগুলো ছুড়েছে তারা। সাংবাদিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্তত ৫ হাজার রকেট পড়ে ইসরায়েলের দিকে। অনেক আবাসিক স্থাপনা, দোকানপাট ও যানবাহনে আগুন ধরে যায়। শুরুতে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে গাজার বেশ কিছু এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়। এরপর একনাগাড়ে রকেট ছোড়া হয়েছে। তখন পুরো আকাশ রকেটে ছেয়ে যায়। তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দেশটির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের এলাকাগুলোতে সতর্কসংকেত বাজিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের রকেট হামলার আভাস দেয়। বোমা থেকে বাঁচতে জনগণকে সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর কাছাকাছি অবস্থানের পরামর্শ দেয়। রকেট হামলার সময় জেরুজালেম শহরেও সতর্কসংকেত বাজানো হয়। তবে সেখানে নিযুক্ত এএফপির এক সাংবাদিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, রকেটগুলো প্রতিহত করা হয়েছে। এদিকে হামাসের হামলার এক পর্যায়ে পাল্টা জবাব হিসেবে গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

হামাস বলেছে, ‘আমরা দখলদারদের (ইসরায়েল) সব অপরাধমূলক কর্মকান্ড অবসানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের জবাবদিহি ছাড়াই তান্ডব চালিয়ে যাওয়ার সময় শেষ হয়েছে। আমরা অপারেশন আল আকসা ফ্লাড ঘোষণা করেছি।’

ইসরায়েলে হামাসের হামলা শুরুর পর একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হাতে আসা ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, হামাস যোদ্ধাদের হাতে আটক একটি ইসরায়েলি ট্যাংকের ওপর উল্লাস করছেন ফিলিস্তিনিরা। এতে আরও দেখা যায়, গাজায় ইসরায়েলের একটি সাঁজোয়া যান চালাচ্ছেন হামাস যোদ্ধারা। এ নিয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চেয়েছিল রয়টার্স। তবে দেশটির কোনো সামরিক ট্যাংক হামাসের কাছে আটক থাকার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। অন্যদিকে হামাস একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এই ভিডিওতে হামাস যোদ্ধাদের বেসামরিক পোশাকে থাকা তিন ব্যক্তিকে আটক করতে দেখা গেছে। ভিডিওটি শুরু হয়েছে একটি বাক্য দিয়ে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামে তাদের লড়াইয়ে আল-কাসেম ব্রিগেডের হাতে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন সেনার আটক হওয়ার দৃশ্য এটি। ভিডিওতে হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন লেখা দেখে বোঝা যায়, সেটি ‘ইরেজ ক্রসিংয়ের’ ইসরায়েলি অংশে ধারণ করা। ক্রসিংটি দিয়ে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকা ও ইসরায়েলের মধ্যে যাতায়াত করা যায়।

এদিকে হামাসের অভিযানের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। পাল্টা যুদ্ধ শুরু করেছি।’ তিনি বলেছেন, ‘এ যুদ্ধে আমরাই জয়ী হব।’ অপরদিকে বার্তা সংস্থা ওয়াফারের খবরে বলা হয়, হামাসের এ হামলাকে সমর্থন জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বসতি স্থাপনকারী এবং দখলদার সৈন্যদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে।’ হামাসের এই হামলাকে ‘ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এতদিন ধরে চলমান নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র খালেদ কাদোমে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই গাজায় সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে আসুক। ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ, আমাদের পবিত্র স্থান আল-আকসায় ইসরায়েলি সহিংসতা বন্ধ হোক। এসব কারণেই আমরা যুদ্ধ শুরু করেছি।’ আরেক খবর অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ গাজায় হামাসের স্থাপনা লক্ষ্য করে পাল্টা বিমান হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলে হামলায় ইরানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও দাবি করছে বাহিনীটি। ইসরায়েলি ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের বিমান হামলায় ১৯৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া : পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। রকেট হামলায় কঠোর নিন্দা জানিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ‘আমরা হতাহত, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।’ একইভাবে ‘নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত’ উল্লেখ করে বিবদমানপক্ষগুলোকে থামার আহ্বান জানিয়েছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশাপাশি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন হামাসের হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ঘৃণ্য হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়ে উভয়পক্ষকে ‘দোষারোপের খেলা’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে উভয়পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে ইরানের মিত্র রাশিয়াও।

প্রেক্ষাপট : গাজায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস। ২০০৭ সালে হামাস গাজায় ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ইসরায়েল উপত্যকাটিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তখন থেকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে বেশ কয়েকবার ভয়াবহ লড়াই হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল সীমান্তে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গাজার কর্মীদের জন্য দুই সপ্তাহ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় আবারও দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। আর তারই জের ধরে গাজা থেকে ইসরায়েল অভিমুখে নতুন এই হামলা হলো।

ফিলিস্তিনি কর্মীদের জন্য ইসরায়েলি সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হয়েছিল। কারণ, গাজায় কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় এসব কর্মী ইসরায়েলে গিয়ে ভালো উপার্জনের সুযোগ পান। গত ২৮ সেপ্টেম্বর আবারও সীমান্তটি খুলে দেওয়া হয়। তখন আশা করা হচ্ছিল, গাজায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এ পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের পাল্টাপাল্টি হামলায় কমপক্ষে ২৪৭ জন ফিলিস্তিনি, ৩২ জন ইসরায়েলি এবং দুজন বিদেশি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকও আছেন।

সর্বশেষ খবর