সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কীভাবে নির্বাচন জিজ্ঞাসা

ঢাকায় ব্যস্ত মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল, পরিস্থিতি যাচাইয়ে দিনভর বৈঠক

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

কীভাবে নির্বাচন জিজ্ঞাসা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ব পরিস্থিতি যাচাইয়ে দিনভর বৈঠক করেছে ঢাকায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। গতকাল সকালে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন তারা। বিকালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় মতামত নিয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। প্রত্যেক বৈঠকেই তারা জানতে চেয়েছেন কীভাবে হতে যাচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচন ও সংশ্লিষ্টরা কে কীভাবে নির্বাচনী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করছেন। সফরসূচি অনুসারে, আজ মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবে। আগামীকাল তারা বৈঠক করবেন নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে।

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই)-এর যৌথ প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন গতকাল থেকেই মূল কাজ শুরু করেছে। সকালে দলটি রাজধানীর আমেরিকান ক্লাবে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক বৈঠক করে। প্রতিনিধি দলের কো-চেয়ার হিসেবে আছে স্টেট ফর সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কার্ল এফ ইনডারফুর্থ এবং ইউএসএআইডি অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সাবেক ডেপুটি বনি গ্লিক। আরও আছেন মালয়েশিয়ার সাবেক হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস সদস্য মারিয়া চিন আবদুল্লাহ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাবেক সহযোগী কাউন্সেল জামিল জাফর, এশিয়া-প্যাসিফিকের এনডিআই রিজিওনাল ডিরেক্টর মনপ্রীত সিং আনন্দ ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে আইআরআইর সিনিয়র ডিরেক্টর জোহানা কাও। এনডিআই এবং আইআরআই সংস্থা দুটি সম্মিলিতভাবে গত ৩০ বছরে ৫০টিরও বেশি দেশে ২০০টিরও বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে।

এ প্রতিনিধি দলটি গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে  পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করে। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সাংবাদিকদের জানান, তারা সবাই অত্যন্ত পরিপক্ব লোক। তারা আসছেন একটা অবাধ নির্বাচন অ্যাসেসমেন্ট করতে। তারা জানতে আসছেন, একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমরা কী কী কাজ করেছি। তাদের নিজেদের কোনো মতামত নেই। তারা শুধু জানতে চেয়েছেন, কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমরা বলেছি, আমাদের এসব দেশে বেশ সংঘাত হয়। নির্বাচন হলে সংঘাত হয়। তবে আমরা একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করব। আমরা একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই। যেখানে ভায়োলেন্সও হবে না। কিন্তু আমরা চাইলেই হবে না। সব দলের মতের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, ভোট বর্জন করতে। আমরা চাই, সবাই নির্বাচন করুক। যাদের গ্রহণযোগ্যতা সে দল জয়লাভ করবে এবং সরকার গঠন করবে। পর্যবেক্ষক দল সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো বার্তা দিয়েছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, কিছু বলেনি। এ সম্পর্কে কোনো আলোচনা করিনি। তবে আমরা চাই, সবাই নির্বাচনে অংশ নিক। কিন্তু আমরা জোর করে কাউকে বলি না নির্বাচনে অংশ নাও। সব দলকে ভোটে নিয়ে আসতে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য, যারা নির্বাচন করতে চায় আমাদের দিক থেকে স্বাগতম। আসা না আসা তাদের সিদ্ধান্ত এবং মাথাব্যথা। ভোট কারচুপি ও বেচাকেনা নিয়ে সরকার সতর্ক অবস্থানে থাকবে বার্তা দিয়ে মোমেন বলেন, আমরা কাউকে জোর করে ভোট দেওয়াই না বা কোনো দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করব না। আমরা চাই, তারা ইচ্ছা মতো ভোট দেবে। এ রকম ব্যবস্থা আমরা করেছি। আমরা বলেছি, ক্যাম্পেইন প্রসেসে যেন কোনো ধরনের ভায়োলেন্স না হয়। যেন ভোট বেচাকেনা না হয় বা ভোট কারচুপি না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক। আমরা চাই না কেউ জোর করে কাউকে ভোট দিতে বাধ্য করুক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নির্বাচকালীন সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দুনিয়ায় যেভাবে নির্বাচন হয় শাসনতন্ত্র মেনে, আমরা সেভাবে নির্বাচন করব। আমাদের শাসনতন্ত্রে নির্বাচনকালীন সরকার বলতে কিছু নেই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বিকালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাসে ইইউ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে করে। পরে সন্ধ্যায় ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেলে সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় করে মার্কিন এ প্রতিনিধি দলটি।

মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, মার্কিন পর্যবেক্ষক দল আসবে কী আসবে না সেটি নির্ভর করবে বর্তমান প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদনের ওপর। তারা সবেমাত্র এসেছে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে পাঠাবে কী পাঠাবে না। আমরা আমাদের কথাবার্তা বলেছি।  প্রতিনিধি দল বদিউল আলম মজুমদারকে কোনো কিছু বলেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা কোনো মন্তব্য করেনি। শুধু জানতে চেয়েছে। আমি আমার কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়েই কথা হয়েছে। কারণ একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন হয়েছে। ২০১৮ সালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। এ নির্বাচন নিয়ে অনেক রকম অভিযোগ আছে। আমাদের একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দরকার। কারণ প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমরা এ সমস্যার সম্মুখীন হই। ৫২ বছরেও আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের পদ্ধতি বের করতে পারিনি। তিনি বলেন, আমি আশা করব আমাদের রাজনীতিবিদরা সংলাপে বসে সমঝোতার মাধ্যমে এর সমাধান বের করবেন। তরুণ প্রজন্ম ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের স্বার্থে তাদের সংলাপে বসা উচিত। তিনি আরও বলেন, আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হলে কিছু পূর্বশর্ত মানতে হবে। নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়। দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি, যার অনেকগুলো ধাপ আছে যেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। কারসাজিমুক্ত হতে হবে। গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ হতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করবে কতগুলো প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে আছে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যম। এগুলোর মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন কী বলে আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না। গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাজেট স্বল্পতার কারণে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে জানিয়েছে। আমি নিশ্চিত নই যে, তারা এ কারণেই পাঠাচ্ছে না। তারা যদি মনে করত পর্যবেক্ষক পাঠানো দরকার তবে তারা সেটি করত। তাদের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানা যায়, সফর শেষে প্রতিনিধি দল ইতিবাচক বিষয়গুলোর পাশাপাশি উদ্বেগের ক্ষেত্রগুলো ও বাস্তবসম্মত সুপারিশগুলো তুলে ধরে একটি বিবৃতি দেবে। তারা সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডার, ওয়াশিংটন ডিসির নীতিনির্ধারক এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক ব্রিফিং ও পরামর্শ করবে।

প্রসঙ্গত, গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্প্রতি ইইউর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। পরে অবশ্য বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন প্রধান ইইউকে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করে চিঠি পাঠিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর