সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন

নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়

নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না, বরং যারা হস্তক্ষেপ করতে চায় তাদের বিরোধিতা করে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্র“প লিমিটেডের সম্মেলন কক্ষে গ্রুপের গণমাধ্যমগুলোর সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এ কথা জানান। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নীতিগত ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার গুরুত্বকে চীন কীভাবে দেখছে জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। নীতিগত অবস্থান থেকে চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী শক্তির বিরোধিতা করে।’ চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। চীন বাংলাদেশের উন্নত ভবিষ্যতের পাশাপাশি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রতি আস্থাশীল।’ চীন তার বাজারে শতভাগ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দেবে কি না এবং এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন টানা ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ চীন থেকে মূলত মেশিন এবং যন্ত্রাংশ আমদানি করে। এটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার মধ্যে বিশ্বে বাজার সম্প্রসারণে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনাকে চীন বেশ গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ থেকে আমের মতো উচ্চমানের পণ্য রপ্তানির জন্য চীন দূতাবাস কঠোর পরিশ্রম করছে। চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল উচ্চ-শ্রেণির শিল্প, যেমন- আইসিটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যানবাহন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি খাতে আরও চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। রাষ্ট্রদূত চীনে ক্যান্টন ফেয়ারসহ বিভিন্ন মেলায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডের পণ্য প্রদর্শনে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার কথা জানান। ইয়াও ওয়েন বলেন, ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম বাজার হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই দুই দেশের বাণিজ্য ও লাভের সম্ভাবনা আছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্তমানে চীন ও বাংলাদেশ এফটিএ আলোচনাকে উৎসাহিত করছে। আমি আশা করি, শিগগিরই এফটিএ নিয়ে সমীক্ষা সম্পন্ন এবং আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চীনের সহযোগিতার সম্ভাব্য খাতগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ এবং আলোচনা বেশ আগে থেকে। গত এক দশকে, বিশেষ করে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর এবং তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মডেল স্থাপিত হয়েছে। পারস্পরিক সম্মান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে চীন সম্পর্ক গড়ে তোলে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি জনগণ। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কৌশলগত অংশীদারের মূল লক্ষ্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, কভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ লড়াই দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে শক্তিশালী, মজবুত বন্ধনের বহিঃপ্রকাশ। এ বন্ধন আগামী বছরগুলোতে আরও দৃঢ় হবে। রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বাংলাদেশ-চীন কৌশলগত অংশীদারিকে আরও উচ্চ স্তরে উন্নীত করতে চারটি পথের কথা বলেন। প্রথমত, দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে নিবিড় আলোচনা। দ্বিতীয়ত, নিজ নিজ মৌলিক স্বার্থের ইস্যুতে পারস্পরিক সমর্থন। তৃতীয়ত, চীন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল আরও একীভূত করা। চতুর্থত, ‘বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগের (গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ, জিসিআই)’ অধীনে সব স্তরের মধ্যে আলোচনা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনা এবং সম্পর্কের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চীন তিন দেশীয় অর্থনৈতিক করিডোরের উদ্যোগ নেবে। এটি এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করবে। রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই)’ ঘোষণা করেছে। এটি বাংলাদেশের উচ্চমানের উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে পুরোপুরি সহায়ক হবে। রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগকে (জিএসআই) কিছু লোক কেবল সামরিক উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখে। কিন্তু জিএসআই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া, খাদ্য ও জ্বালানি সুরক্ষা, ডেটা ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য এবং আন্তর্জাতিক সংঘটিত অপরাধ মোকাবিলার মতো অপ্রথাগত সুরক্ষায় গুরুত্ব দেয়। এখানে বাংলাদেশেরও স্বার্থ আছে। বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও সফর বিনিময়ের কথা জানান রাষ্ট্রদূত।

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই)’ অধীনে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাংলাদেশে কর্মরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, বিআরআইর অধীনে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা এখন ফল পাওয়ার পর্বে প্রবেশ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিআরআইয়ে যোগ দিয়েছে। গত সাত বছরে বঙ্গোপসাগরে বিআরআইয়ের শিকড় আরও জোরালো ও প্রস্ফুটিত হয়েছে। চীন বাংলাদেশে ১২টি সড়ক, ২১টি সেতু এবং ২৭টি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প নির্মাণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিআরআই সম্পর্কে উচ্চ কণ্ঠে বলেছেন, এটি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের একটি নতুন দ্বার উšে§াচন করেছে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি চীনা উদ্যোগ কাজ করছে এবং কয়েক হাজার চীনা নাগরিক এখানে বসবাস করছে। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে দূত হিসেবে তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত এবং তাদের বৈধ স্বার্থ রক্ষা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সর্বদা বন্ধুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়ছে। রাষ্ট্রদূত দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক জোরদারে চীনের উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন। 

মতবিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক জুয়েল মাজহার, ডেইলি সান সম্পাদক রেজাউল করিম লোটাস, নিউজটোয়েন্টিফোরের নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহাসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। আলাপচারিতা শেষে চীনের রাষ্ট্রদূত ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্র“প লিমিটেডের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখেন। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। চীনা দূতাবাসের কূটনীতিকরা এ সময় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছিলেন।

সর্বশেষ খবর