শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে নির্বাচনি সরকারের

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ছোট হবে মন্ত্রিসভা, তফসিল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী নভেম্বরের শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। সে হিসেবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই গঠন করা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার। রাজনীতির মাঠসহ সর্বত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কেমন হবে নির্বাচনকালীন সরকার। কারা থাকবেন নির্বাচনকালীন সরকারে, আকার কী হবে এ নিয়ে গুঞ্জনের শেষ নেই। চূড়ান্ত রূপ নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই কারোরই। মন্ত্রিসভার আকার কেমন হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এটি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।

সরকারের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভার আকার ঠিক রাখা হলেও এবার ছোট করা হতে পারে। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আগ্রহ বাড়ছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। কী হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের- এদিকে দৃষ্টি এখন সবার। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছিল তার আকার ছিল ২৯ সদস্যের। এর বাইরে ১০ জন উপদেষ্টা ছিলেন। সব মিলিয়ে ছিলেন ৩৯ জন। সেবার বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বাদ দেওয়া হয়। নতুন কিছু মুখ যুক্ত করা হয়েছিল। এবারও তা করা হতে পারে। এদিকে নিজেদের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকার হিসাব মেলাতে খোঁজখবর রাখছেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী শেষ সময়ে এসে গুছিয়ে নেওয়ার কাজ করছেন।

নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা কেমন হবে- এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত নেবেন মন্ত্রিসভার আকার ছোট হবে নাকি বড় হবে।’ 

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে পারে কিছু নতুন মুখ। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন ব্যক্তিদের দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে এক-দুজন, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একজন, জাসদ থেকে একজনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হতে পারে। এমনকি গণফোরাম, জেপি, তরীকত ফেডারেশন ও সংসদে এমপি আছেন এমন ব্যক্তি, যার সারা দেশে ইমেজ আছে, চমক হিসেবে তাদের কাউকে মন্ত্রিসভায় দেখা যেতে পারে। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এবারও সে চমক থাকতে পারে বলে জানা গেছে। 

নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা না হলে বর্তমান মন্ত্রীরাই রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন। এসব মন্ত্রীর মধ্যে যারা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তারা নিরাপত্তা নিতে পারবেন, কিন্তু কোনো প্রটোকল নিতে পারবেন না।  

তথ্যমতে, সংবিধানের আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের আগে বর্তমান মন্ত্রিসভা ছোট করার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সময়কার মন্ত্রিসভাকে নির্বাচনকালীন সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলা হলেও কার্যত এটি বর্তমানের মতো স্বাভাবিক সরকারই থাকবে। নতুন প্রকল্প হাতে না নিলেও বর্তমানের কাজ অব্যাহত থাকবে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ওই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কার অধীনে হবে, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে স্পষ্ট বলা নেই। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার পরিবর্তন বা পদত্যাগ করারও বিধান নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনকালীন সরকারের নির্বাহী বিভাগ ইসিকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে। সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন, এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ সংবিধানের ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে, তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন।’

অন্যদিকে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ কিছু কিছু কাজে সরকারকে কমিশনের অনুমতি নিতে হয়। ওই সময়ে নির্বাচনে প্রভাব ফেলে এমন কর্মকান্ড বিধিনিষেধ আরোপ থাকে। অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন এবং নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রেও এটাই প্রযোজ্য হবে।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার আরেকটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, এটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যারাই দায়িত্বে আছেন, তারা দায়িত্বে থাকবেন। পদত্যাগ বা অন্য কাউকে আনতে হবে- এ বিধান সংবিধানে নেই।’ তিনি বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার আরেকটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে- এর মধ্যবর্তী অন্য কোনো বিধান নেই। এই বিধান করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এ সংশোধনী যখনই সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়েছে, আগের যে ব্যবস্থা হয়েছিল, সেই অবস্থা পুনরায় স্থাপিত হয়েছে।’

এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে চায় নির্বাচন কমিশন। সে জন্য সব দলকে নির্বাচনে আনতে ভোটের একাধিক তারিখও রাখা হতে পারে। এবার ৫০ থেকে ৬০ দিন হাতে রেখেই নির্বাচনের তফসিল দেবে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া ব্যালট পেপারে ৩০০ আসনে ভোট করতে প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।

সংসদ নির্বাচনের তফসিল এবং ভোটগ্রহণ কবে হবে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আশা করছি, নভেম্বরের শুরুর দিকে তফসিল ঘোষণা হবে। তার আগে দিনক্ষণ নিয়ে কমিশন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। তবে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, আমরা ঐকান্তিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি একটা অবাধ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানের জন্য। আশা করছি, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।’ 

ইসি আহসান হাবিব আরও বলেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিলে সচরাচর যে সময় দেওয়া হতো এবার তা থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টি আলোচনায় আছে। বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসারসহ অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তার সব কর্মকান্ড ও প্রশিক্ষণ এবং প্রার্থীদের আপিল/শুনানিতে তাড়াহুড়া না করে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ধাপে ধাপে যুক্তিযুক্ত সময় দেওয়া এবং বাস্তবতার নিরিখে কার্য সুসম্পন্ন করতে যত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করে তফসিল চূড়ান্ত করবে নির্বাচন কমিশন। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষের দিকে। নির্বাচনী মালামালও কেনাকাটা চলছে। যথাসময়ে সব মালামাল ইসির হাতে পৌঁছবে। সাংবিধানিকভাবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সেক্ষেত্রে ১ নভেম্বর শুরু হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ও ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। এবার ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট করতে গেলে নভেম্বরের শুরু থেকে দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যেই ভোটের তফসিল ঘোষণা করতে হবে ইসিকে।

সর্বশেষ খবর