বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গুজব রোধে অ্যাকশনে পুলিশ

♦ চলতি বছর ১৪১০ গুজব শনাক্ত, চলতি মাসেই ৯৬টি ♦ সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন সংস্থা, সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি

সাখাওয়াত কাওসার

গুজব রোধে অ্যাকশনে পুলিশ

চলতি বছরের ৫ মার্চ পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন দুজনকে হত্যা করেছে। ফেসবুকে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে পঞ্চগড় শহর। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। কিছু যুবক জ্বালানি কাঠ নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে সড়কের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর তারা ধাক্কামারা মোড়ে ঢাকা-পঞ্চগড় সড়ক অবরোধ করে। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে নগরীর ট্রাক টার্মিনালের সামনে কয়েকশ ক্ষুব্ধ মানুষ একত্র হয়ে মাইক্রোবাসে আগুন দেয়। এ সময় দোকানে লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। একই সময় শহরের ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় র‌্যাবের ওপরও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। তাদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় আহত হন র‌্যাবের তিন সদস্য। নিউইয়র্কে বিশ্বব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়েছে দাবি করে চলতি বছরের ২ মে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওটি এডিটেড হওয়ার প্রমাণসহ পরদিন ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফেসবুকে অন্তত ৫০ লাখ বার দেখা হয়েছে ভিডিওটি। তাছাড়া ‘ফ্যাক্টচেকে’ বিষয়টি এডিটেড প্রমাণ হওয়ার পরও গুজবটি আরও অনেক ফেসবুক পেজ-গ্রুপ থেকে ছড়িয়েছে।

‘জোর করে বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন হাসিনা’ শিরোনামে আনন্দবাজার পত্রিকার স্ক্রিনশট যুক্ত করে গত ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। তবে অনুসন্ধান করে পরদিন সকালেই রিউমর স্ক্যানার দেখতে পায় ভাইরাল স্ক্রিনশট বা ছবিটি এডিটেড। তবে ওই অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তত ২০-৩০ লাখ মানুষের কাছে ছড়িয়ে গিয়েছিল এই গুজবটি।

এ তো গেল মাত্র তিনটি গুজবের ঘটনা। তবে এমন অসংখ্য গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে দুর্বৃত্তরা। পরিকল্পনামাফিক বাড়িয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে উস্কে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর সব ঘটনায়। ঘটছে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, এমনকি ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টার মতো ঘটনা। গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব ও হোয়াটস অ্যাপের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি মার্কিন ভিসানীতির পর থেকে গুজব ছড়ানোর মাত্রা অনেক বেশি। আগামী দিনগুলোতে এর মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের। তারা বলছেন, দেশ ও বিদেশ থেকে একটি চক্র পরিকল্পিভাবে ছড়াচ্ছে এসব গুজব। বেশিরভাগ গুজবই তৈরি হচ্ছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। যদিও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, এসব গুজব-অপপ্রচার ঠেকাতে জিরো টলারেন্সের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।

গত সোমবার মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, গুজব প্রতিরোধে পুলিশের সব সদস্যকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। যাতে করে কেউ গুজব সৃষ্টি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। জনগণের সামনে সত্য উন্মোচন করে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। সমাজের বিশৃঙ্খলাকারী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে প্রযুক্তিতে দক্ষ সরকারবিরোধী সাইবার কর্মীরাই গুজব ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হয়েছে। টার্গেট করে ব্যক্তিগত বিষয়াদি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দেশের চিন্তাশীল মানুষের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে কল্প-কাহিনি। তরুণ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ তাদের টার্গেট। গত ১৬ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা কেন্দুয়ার আমতলা গ্রামে যুবক হত্যার গুজব ছড়িয়ে চারটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এ সময় হামলাকারীরা নেত্রকোনা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলামের খামার থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার ১১টি গরু লুটের ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি গুজব প্রচারে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনের আদলে স্ক্রিনশট তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ সহজেই বিশ্বাস করছে। গুজবের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না রুপালি পর্দার সেলিব্রেটি, ক্রিকেটার, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, দেশে অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পরিকল্পিতভাবে এসব গুজব ছড়াচ্ছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। অনেকে ভিডিও ভাইরাল করার উদ্দেশ্যেও চটকদার মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে।

গুজব প্রতিরোধের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অত্যন্ত সিরিয়াস। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে যে কোনো খবর শেয়ার এবং প্রচার করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজব প্রতিরোধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। অন্যান্য আইনের অংশ হিসেবে গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এতে করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না- বলছেন, আইন বিশেষজ্ঞরা। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাইবার স্পেসে সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি করছি। কিছু লোক দেশে-বিদেশে অবস্থান করে পরিকল্পনা করে কাজটি করে যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই তাদের অনেককেই শনাক্ত করেছি। যারা দেশে অবস্থান করে এসব ভুয়া খবর শেয়ার করেছেন এবং গুজব সৃষ্টি করেছেন তাদের ইতোমধ্যে আইনের আওতায়ও নিয়ে আসা হয়েছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ সূত্র বলছে, চলতি অক্টোবর মাসের গতকাল পর্যন্ত ৯৬টি গুজব শনাক্ত করেছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই সংখ্যা ছিল ১৭৯টি। জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১৮০, ফেব্রুয়ারিতে ১১৩, মার্চে ১৪৮, এপ্রিলে ১৫০, মেতে ১৫৩, জুনে ১১১, জুলাইয়ে ১২৮, আগস্টে ১৫২টি গুজব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪১০টি গুজব শনাক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি। যার বড় একটি অংশই ছিল রাজনৈতিক গুজব। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জড়িয়ে গত আট মাসে ৭৪টি গুজব ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে। অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফরম ডিসমিসল্যাবের হিসাবে গত জুলাই থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত যত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে তার ৪৪.৪ শতাংশই রাজনীতিবিষয়ক। সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তার চেক নিয়েছেন’ এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে কিছুদিন আগে। রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে, চেকটি বার কাউন্সিলের একটি প্রণোদনার চেক থেকে সম্পাদনা করা।

‘অক্টোবরের মাঝামাঝি তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পাচ্ছেন ড. ইউনূস : পিটার হাস’ এমন শিরোনামে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনের আদলে তৈরি স্ক্রিনশট ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েক মাস ধরে। তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এমন কোনো মন্তব্য করেননি এবং ওই দৈনিকটিও সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রকাশ করেনি।

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৭০-৮০ লাখ প্রবাসী দেশে আসতে প্রস্তুত’ শীর্ষক একটি তথ্য একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্র দিয়ে বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের নামে পরিচালিত দুটি ভুয়া ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করা হয়। তবে শামা ওবায়েদ বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তার নামে একাধিক ভুয়া পেজ আছে। এ ব্যাপারে তিনি থানায় জিডি করেছেন। সম্প্রতি, ‘সরকারি দেশি মদের দোকান’ লেখা একটি সাইন বোর্ডের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। সাইন বোর্ডটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ও আওয়ামী লীগের লোগোর ছবি দেখা যাচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার মাহমুদ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এটা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট যে, যারা এগুলো করছেন তার টার্গেট করেই করছেন। এমনও ঘটেছে আমরা গুজব নিশ্চিত করার পরও কিছুদিন পর তা আবার নতুন করে শেয়ার করছেন। আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক গুজবগুলোর বিষয়ে বেসরকারি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গুজব প্রতিরোধ টিম কাজ করলেও তা যথেষ্ট নয়। এ নিয়ে নেই সরকারি কোনো তৎপরতাও। গুজব প্রতিরোধে বিটিআরসি, আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রয়েছে একটি গুজব প্রতিরোধ কমিটি। এ ছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং তথ্য অধিদফতরের দুটি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটি শুধু মন্ত্রণালয়ভিত্তিক গুজব নিয়ে কাজ করে।

সর্বশেষ খবর