শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংলাপে সাড়া নেই কারও

শফিউল আলম দোলন ও রফিকুল ইসলাম রনি

সংলাপে সাড়া নেই কারও

সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারকে যে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে তার প্রথমটিই হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ প্রস্তাবে তাদের আপত্তি নেই। তবে সংলাপ হতে হবে যে কোনো শর্তমুক্ত। এদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ একাধিক শর্ত দিয়ে আন্দোলন কর্মসূচিতে রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি ও তাদের জোট সঙ্গীদের আনতে আওয়ামী লীগের ওপর চাপ আছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতায় সংলাপ বা আলোচনার বিকল্প কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে এলেও এখনো নিজেদের অবস্থানে অনড় বড় দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সংলাপে সাড়া নেই কারও। বিএনপি বলে আসছে, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। এর অংশ হিসেবে গত কয়েক বছরে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেগুলোতে কোনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা। এখন সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগও বলে আসছে, উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ায় এটি আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। আগামী নির্বাচন হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদে রেখে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই বিএনপির সঙ্গে বসার প্রয়োজনীয়তা নেই।

এর আগেও জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সংলাপে বসেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলের নেতাদের মধ্যে সবশেষ সংলাপটি হয় ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনের আগে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দন্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। সেবার বিএনপি নির্বাচনে আসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের একটি জোটের মাধ্যমে। সেই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সংলাপের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে সম্মত হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি জোট। একাধিক প্রার্থী, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপি সেই নির্বাচনে পেয়েছিল মাত্র সাতটি আসন।

সংলাপের প্রয়োজনীয়তা দেখছে না আওয়ামী লীগ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো সংকট আছে বলে মনে করেন না তারা। সংলাপ নিয়ে বিদেশিদের চাপ থাকলেও বিএনপি বেশকিছু শর্ত দেওয়ায় ক্ষমতাসীনরা সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দলটির নেতারা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ায় এটি আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। আগামী নির্বাচন হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদে রেখে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে। কাজেই সংবিধান মেনে বিএনপিকে ভোটে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে। বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না। নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। সে সময় সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি চাইলে অন্য কিছু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। কিন্তু তাদের যে শর্ত তা দিয়ে কোনো সংলাপ হবে না, হবে না।’

৯ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল বৈঠক করে। এ সময় আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে এবং এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ আছে কি না, সেটিও জানতে চায় প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগ বলেছে, বিএনপি যে এক দফা দাবি করেছে সেটা করেই দলটি সমঝোতার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফের গঠন, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্বাচন কমিশন বাতিল- এগুলো সম্ভব নয় বলে প্রতিনিধি দলকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় এসব বিষয়ে জানান।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে। এখানে কে আসবে, কে আসবে না- তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও কেউ সংলাপ করতে চাইলে নো কন্ডিশন, উইদাউট কন্ডিশনে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কার সঙ্গে সংলাপ? কীসের সংলাপ? বিএনপি দাবি করে তারা বিরোধী দল? সংবিধান অনুযায়ী কি সেটা বলা যায়? আর আলোচনা করা যেত যদি তারা শর্ত না দিত, তারা যদি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করত। বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।’ 

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার সুযোগ বিএনপিই নষ্ট করেছে। কারণ তারা সংবিধানের বাইরে গিয়ে একাধিক শর্ত দিয়েছে। যেগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনার সুযোগ থাকছে না।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারা সরকার উৎখাত করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলে। নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে বলে। তারা সংবিধান মানে না। দেশের প্রচলিত আইন মানে না। তাদের সঙ্গে কীসের সংলাপ? হ্যাঁ, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারে যদি তারা নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেনে নেয়, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনে আসতে চায়, অতীতের বক্তৃতা-বিবৃতির জন্য যদি ক্ষমা চায় তাহলে ভেবে দেখব। এর আগে কোনো সংলাপ করার প্রয়োজনীয়তা দেখি না।

আওয়ামী লীগের এজেন্ডায় কোনো সংলাপে যাবে না বিএনপি : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্ধারণ করা এজেন্ডায় কোনো সংলাপে যাবে না বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সদস্যরা বলেছেন, সংলাপ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। কিন্তু এ সংলাপ করতে হলে আগে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাসীন সরকারের কারও সঙ্গে কোনো সংলাপে যাবেন না তারা। তাদের মতে, ১৫ বছর ধরে গুম, খুন, হামলা-মামলা, গ্রেফতার-রিমান্ড, গায়েবি মামলায় সাজা ও জেল-জুলুমের অব্যাহত শিকার দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী। বিএনপি এতটা সংলাপবিলাসী নয় যে, এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের আরেকটা একতরফা নির্বাচনকে জায়েজ করার জন্য তাদের কাছ থেকে প্রহসনের সংলাপের ডাক পাওয়ামাত্রই দৌড়ে গিয়ে যোগ দেবে।

এ বিষয়ে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ লড়াই করছে, যাদের বিরুদ্ধে সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব আজ মাঠে নেমে গেছে, তাদের সঙ্গে তাদের দেওয়া শর্তে আবার কীসের সংলাপ? এ সংলাপের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, মানুষ আজ আওয়ামী লীগ নামের এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়। ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য আজ কঠিন যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছে। জনগণ এদের কবল থেকে মুক্তি চায়। তারা আজ ঐক্যবদ্ধ। সমগ্র দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ আজ জেগে উঠেছেন। ইনশা আল্লাহ পরিবর্তন আসন্ন।     

বিএনপি স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, আমরাও সংলাপ চাই। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি সবার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, যাদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে এত বড় ভোট ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে, যারা দিনের ভোট রাতে করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে, সেই আওয়ামী লীগের নির্ধারিত এজেন্ডায় বিএনপি সংলাপে যাবে?- এটা কি যৌক্তিক কোনো কথা হলো? সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিষ্কার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংলাপে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যেই বলেছেন, ২৮ অক্টোবর থেকেই শুরু হবে আন্দোলনের মহাযাত্রা। বুধবারের সমাবেশ থেকে তিনি জনগণের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে শেষ বার্তা দিয়েছেন। সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করবে না বিএনপি। এটা ছাড়া বিএনপি কোনো সংলাপে যাবে না। সরকারের পদত্যাগসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ঘোষণা দেওয়ার পরেই শুধু সংলাপে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে বিএনপি।  বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি মানুষের ভোটাধিকার এবং দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সংলাপে যেতে চায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই হচ্ছে এ সংলাপের সবচেয়ে বড় বাধা। কারণ আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচনের কথা বলছে এবং তারা সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার শর্ত দিচ্ছে। ফলে সংলাপের পথ আওয়ামী লীগই বন্ধ করে দিয়েছে। অতএব ফয়সালা হবে এবার রাজপথেই।

সর্বশেষ খবর