মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিগন্যালের ভুলে লাশের সারি

কিশোরগঞ্জে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৭, আহত ২ শতাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

সিগন্যালের ভুলে লাশের সারি

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে বগি দুমড়ে মুচড়ে গেছে। হতাহত হয়েছেন অনেকে। হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন স্থানীয় ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা। তারা বলছেন, দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২ শতাধিক। গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ভৈরব জংশনের আউটার পয়েন্ট ক্রসিংয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী এগারোসিন্দুর যাত্রীবাহী ট্রেনের পেছনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেন ধাক্কা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও যাত্রীরা বলছেন, সিগন্যালের ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেছেন, কনটেইনারবাহী ট্রেনটির চালক ও সহকারী চালক সিগন্যাল অমান্য করেছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে, ভয়ংকর এই দুর্ঘটনায় দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার সিরাজ-উদ-দৌলা খান। সরেজমিন জানা যায়, বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে একটি কনটেইনারবাহী ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করে। তার আগ মুহূর্তে ভৈরব থেকে এগারসিন্দুর ট্রেন ঢাকার দিকে রওনা হয়। গাইনাহাটি এলাকায় জগন্নাথপুর রেল ক্রসিংয়ে এগারসিন্দুর ট্রেনের শেষের দুই-তিনটি বগিতে কনটেইনারবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন আঘাত করে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশের এলাকা। চোখের পলকেই এগারোসিন্দুর তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। ট্রেনে থাকা যাত্রীদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। খবর শোনামাত্র ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বগির নিচে চাপা পড়া অসহায় মানুষের আর্তচিৎকারে নিজেদের সংযত রাখতে পারেননি উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া অনেকেই। অসহায় এসব উদ্ধারকর্মীর চোখ থেকে টলটল করে পানি ঝরছিল। তখন পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের বগি থেকে একে একে লাশ বের করা হচ্ছিল। ভৈরব বাজার ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মোশাররফ হোসেন বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত এগারসিন্দুর গোধূলির তিনটি বগি থেকে একের পর এক লাশ বের করা হচ্ছে। বগির নিচে আরও অনেকে চাপা পড়েছেন। তাদের উদ্ধারে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ট্রেন দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে হাজারো উৎসুক জনতা ভিড় করছেন। উৎসুক জনতার কারণে উদ্ধার কাজেও বেগ পেতে হচ্ছে উদ্ধারকর্মীদের। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, স্টেশন মাস্টারের অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। উদ্ধারকারীরাও দেরি করে ঘটনাস্থলে এসেছেন। বেলা সাড়ে ৫টার দিকে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ ১৭টি লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছিলেন, উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দুর্ঘটনার খবর শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, এ পর্যন্ত আহত ৭০ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। ২১ জনকে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার্থে পাশের কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আরও চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ আনা হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, সিগন্যালিংয়ের কোনো জটিলতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। ভৈরবের এই ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। উদ্ধার কাজের জন্য রিলিফ ট্রেন রওনা দিয়েছে ঢাকা থেকে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

দুটি তদন্ত কমিটি : ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনায় বিভাগীয়ভাবে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার সিরাজ-উদ-দৌলা খান জানান, রেলওয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ আলাদাভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা : ভৈরবে বসবাসকারী বাজিতপুরের কলেজছাত্র শাহরিয়ার রহমান জানান, তার স্ত্রীর বড় ভাই নিরব এগারসিন্দুর ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি গিয়ে নিরবকে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, ১৫টি লাশ তিনি নিজে দেখেছেন। ট্রেনের নিচে চাপা পড়া আরও কয়েকজনকে দেখেছেন, যাদের কারও হাত বা পা বের হয়ে রয়েছে। ট্রেনটি পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারলে আরও লাশ পাওয়া যাবে। তিনি নিজে উদ্ধার কাজে অংশ নিতে চাইলেও র‌্যাব ও পুলিশ তাকে যেতে দেয়নি। সেখানে অনেক লোক ভিড় করায় তাদের সামলাতে র‌্যাব ও পুলিশকে হিমশিম খেতে হয় বলেও জানান তিনি। সিগন্যালের ত্রুটির কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে ট্রেনযাত্রীদের কাছ থেকে জেনেছেন তিনি।

২৫ হাজার টাকা অনুদান : জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।

রেল যোগাযোগ বন্ধ, তিনজন বরখাস্ত : কিশোরগঞ্জের ভৈরব জংশনের আগে জগন্নাথপুর রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় কনটেইনারবাহী ট্রেনের লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার ও গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান।

 

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর