মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফোনে কথা বলতে বলতেই না ফেরার দেশে গোলাপ

মাহবুব মমতাজী, ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) থেকে

ফুফাতো বোনের গর্ভে অনাগত সন্তান। স্বামীর সঙ্গে সিলেটে থাকেন অসুস্থ বোনটি। সন্তান প্রসবকালীন তাকে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে রাখতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে সিলেটে যান গোলাপ (৩২)। বোনকে নিয়ে সিলেট থেকে রবিবার তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার গলেয়ায় পৌঁছান।

গত কয়েক দিনে বাবাকে কাছে না পেয়ে দুই রাত না ঘুমিয়ে কান্না করছিল গোলাপের দুই বছরের মেয়েটি। রাজধানীর কালশীর পলাশনগরে সপরিবারে থাকেন গোলাপ। এখানে তাদের একটি জুতার কারখানা আছে। গতকাল দুপুর ১টায় ঢাকায় ফেরার জন্য কিশোরগঞ্জ স্টেশন থেকে এগারোসিন্দুর ট্রেনের পেছনের বগিতে ওঠেন তিনি। বিকাল ৫টার মধ্যে ঢাকায় ফিরবেন বলেও ছোটভাই বকুলকে ফোন করে জানিয়ে রাখেন। এরপর বেলা সোয়া ৩টায় ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেনটি। সংবাদ মাধ্যমে দুর্ঘটনার খবরটি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বড়ভাই গোলাপকে ফোন করেন বকুল। অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ করা হয় গোলাপের ফোনটি। মাত্র ১০ সেকেন্ড। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলছিল, ‘আমি মারা যাচ্ছি।’ আর কিছু বলতে পারেননি গোলাপ। এর কিছু সময় পর ফোনই বন্ধ।

অজানা আশঙ্কায় বৃদ্ধ বাবা ও বড় বোন নিপাকে সঙ্গে নিয়ে ভৈরবে রওনা করেন বকুল। এদিকে তাদের গ্রামের বাড়ি কটিয়াদী থেকেও দুজন স্বজন ভৈরব স্টেশন আর চি বে ১০০ শয?্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গোলাপের খোঁজ করতে থাকেন। ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় লাবিবা পরিবহনের একটি বাসে করে ভৈরব রওনা করেন বকুল, তার বাবা ও বোন। যাত্রাপথেই এ প্রতিবেদককে এসব জানাচ্ছিলেন বকুল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বাসটি যখন গাজীপুরের পূবাইল এলাকা অতিক্রম করছিল তখন গোলাপের লাশ খুঁজে পাওয়ার তথ্য পান বকুল। মুহূর্তে কান্নার রোল পড়ে বাসের ভিতরে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন গোলাপের বাবা কাশেম আর বড় বোন নিপা। নিপা আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, গত বছরের  কোরবানির ঈদে পানিতে ডুবে দেড় বছরের ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। এবার  ভাইকেও হারালেন। রাত সাড়ে ১০টায় চি বের হাসপাতালে তারা পৌঁছান, এখানে নার্স রুমে রাখা গোলাপের লাশ শনাক্ত করেন। পুরো হাসপাতালের নিচতলায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসতে থাকে স্বজনদের আহাজারি। লাশ রাখা ঘরের পাশেই খোলা হয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম। এখানে দায়িত্বরত পিআইও সাগর হোসেন সৈকত জানান, মোট লাশ ১৭টি। স্টেশন থেকে একটি লাশ স্বজনরা নিয়ে গেছেন। আর হাসপাতালে আনা ১৬টির মধ্যে ১৫টির পরিচয় পাওয়া গেছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া লাশগুলো হলো- ভৈরবের আকতার হোসেন, সোমা আক্তার, লক্ষ্মীপুরের হুমায়ুন কবির, পিরোজপুরের আছির উদ্দিন, ভৈরবের সবুজ চন্দ্র শীল, রাব্বী, কিশোরগঞ্জের সাইমন মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজাম উদ্দিন সরদার, ঢাকার জালাল আহমেদ, ময়মনসিংহের সুজন মিয়া, ফাতেমা, সজীব ও ইসমাইল, কিশোরগঞ্জ মিঠামইনের রাসেল মিয়া, কটিয়াদীর গোলাপ। এ ছাড়া  আহত হয়েছেন শতাধিক। এদের মধ্যে গুরুতরদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাদেক ও তার বন্ধু মো. নাঈম জানান, তাদের বগিতেই আসনবিহীন যাত্রী ছিলেন শতাধিক। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না বগিতে। দুর্ঘটনায় বগি দুটি লাইন থেকে ছিটকে এক পাশে হেলে পড়ায় কয়েক শ যাত্রী একজন অন্যজনের ওপর চাপা পড়েন।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, আর যাত্রীবাহী এগারসিন্ধুর ট্রেনটি যাচ্ছিল ভৈরব থেকে ঢাকার দিকে। ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ দুই বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের দুটি বগি উল্টে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারকাজে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর