বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হামুনের তাণ্ডব কক্সবাজারে

নিহত ৩ আশ্রয় কেন্দ্রে পৌনে ৩ লাখ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

হামুনের তাণ্ডব কক্সবাজারে

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়া বাড়িঘর (ওপরে) ও গাছপালা

ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করেছে। ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে এটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। পরের কয়েক ঘণ্টায় মূলত কক্সবাজারের ওপর এ ঝড়ের তান্ডব চলে। রাত ১০টার পর ঝড়ের শক্তি অনেকটা কমে যায়। পরে মিয়ানমারের দিকে চলে যায়।

ঘূর্ণিঝড় হামুনের তান্ডবের মধ্যে কক্সবাজারে দেয়াল ও গাছচাপা পড়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজনের নাম জানা যায়। তারা হলেন- আবদুল খালেক ও হারাধন। তবে জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান দুজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দুজনের মধ্যে পৌর এলাকায় একজন দেয়ালচাপায় আর মহেশখালী উপজেলায় গাছচাপায় একজন মারা গেছে। ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে উপকূলের অনেক জায়গায় স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল এতে প্লাবিত হয়েছে।

শহরে গাছপালা, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সঞ্চালন লাইন। ঝড়ে গাছপালা ভেঙে পড়েছে। কক্সবাজার জেলা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পৌনে ৩ লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। আবহাওয়া অফিস ধারণা দিয়েছিল, গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে এ ঝড় উপকূল অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু শেষ দিকে গতি বেড়ে যাওয়ায় হামুন উপকূলে আঘাত হানে সন্ধ্যা ৬টায়, গতিপথ কিছুটা বদলে এ ঝড় চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশ ও কক্সবাজারের ওপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে কুতুবদিয়ার কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম শেষ করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।  এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা শেষে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছি না। অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের মতো এটিও মোকাবিলা করতে পারব।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১০ জেলার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছি। গবাদি পশুকেও সরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছি। মেডিকেল টিমও প্রস্তুত রয়েছে।’ এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সারা দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ : ঘূর্ণিঝড় হামুন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ায় সারা দেশে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। গতকাল দুপুর আড়াইটা থেকে সারা দেশে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনেক যাত্রী লঞ্চ বন্ধের এ সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন, সদরঘাট এসে ফিরে যান। গতকাল সকালে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত জারির পর উপকূলীয় অঞ্চলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : চট্টগ্রাম : অতিবৃষ্টিতে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ধসের শঙ্কা রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মহানগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে মাইকিং করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। খুলেছে কন্ট্রোল রুম। সিভিল সার্জন কার্যালয় প্রস্তুত রেখেছে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর সমন্বয়ে ২৯০টি টিম। চট্টগ্রাম বন্দর জারি করেছে নিজস্ব সতর্কসংকেত ‘অ্যালার্ট-৩’। ঘূর্ণিঝড় আঘাতের সতর্কতা হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিমানবন্দরসূত্র জানান, আজ বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

বরিশাল : বরিশালে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বরিশাল নদীবন্দরে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় লঞ্চ চলাচল। ভোলা : চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে নৌকা, ট্রলার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বরগুনা : সকাল থেকে থেমে থেমে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। লঞ্চ, খেয়া পারাপার বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলায় ৬৪২টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম। কলাপাড়া : কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় আতঙ্কিত উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ। কুয়াকাটা ছেড়ে গেছেন অনেক পর্যটক। বাগেরহাট : সুন্দরবনে থাকা দেশি-বিদেশি সব পর্যটকসহ বনজীবীদের লোকালয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৪৪৬টি আশ্রয় কেন্দ্র। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী জানান, মোংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। খুলনা : খুলনায় ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব শেল্টারে ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন আশ্রয় নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন। রাঙামাটি : জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান বলেন, রাঙামাটিতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরতদের জন্য স্থানীয় বিদ্যালয়গুলো আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। পিরোজপুর : জেলায় ৪০৭টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আটটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ৬৩টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাতক্ষীরা : ৩০০ সাইক্লোন শেল্টার, প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবার স্যালাইন, সুপেয় পানি ও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, নগদ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেছেন, যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর : জেলায় স্থায়ী ১৮৫ ও অস্থায়ী ১০০ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নোয়াখালী : জেলায় ৪৮৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। ৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও ১০২টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। পটুয়াখালী : পটুয়াখালীতে ৭০৩টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র আর ৩৫টি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রয়েছে। এসব সাইক্লোন শেল্টারে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ মানুষ ও প্রায় ১ লাখ গবাদি পশু আশ্রয় নিতে পারবে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। কুতুবদিয়া : মাইকিং, সাইক্লোন শেল্টার, সুপেয় পানি, শুকনো খাবার, জরুরি ওষুধসহ মেডিকেল টিম গঠন এবং কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। ঝালকাঠি : ৫৯টি সাইক্লোন শেল্টার, সাতটি কন্ট্রোল রুম, ৩৭টি মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিসের তিনটি উদ্ধারকারী দল প্রস্তুত রয়েছে। গতকাল সকাল থেকে কখনো হালকা, কখনো মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর