বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আনসার বাহিনীর গ্রেফতার ক্ষমতা নিয়ে যত আলোচনা

আইনি বৈধতা চায় আনসার

নিজস্ব প্রতিবেদক

অভিযুক্তকে আটক, দেহতল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছে আনসার ব্যাটালিয়ন। বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ সোমবার সংসদে ওঠার পর থেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। অপরাধ ও আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আনসার বাহিনীকে এমন ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে পুলিশে কর্মরতরা এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এদিকে আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই আনসার সদস্যরা আনঅফিসিয়ালি এই কাজটি করে আসছেন। এবার আইনি বৈধতা চাচ্ছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, কারও ক্ষমতা খর্বের আশঙ্কা থাকলে তারা বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না হলে বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ নেই। জানা গেছে, প্রস্তাবিত বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্যের সামনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করে অবিলম্বে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।’

জানা গেছে, বর্তমানে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে একটি গার্ড ব্যাটালিয়ন, দুটি মহিলা ব্যাটালিয়নসহ ৪২টি আনসার ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬টি ব্যাটালিয়নের ৭ হাজার সদস্য দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এককভাবে ৬০টি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ১৮০টি ক্যাম্পে ঝুঁকি নিয়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ এ কাজ করে যাচ্ছে। ওইসব কাজে প্রশিক্ষিত আনসার সদস্যরা ব্যবহার করছেন উন্নত প্রযুক্তির আগ্নেয়াস্ত্র। আনসার ও ভিডিপি একাডেমিতে আনসার বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তাদের যুগপোযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা নিয়মিতভাবে বিদেশেও প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এ বাহিনীর সদস্যরা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায়ও অংশ নেয় তারা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আনসার বাহিনীকে আরও আগেই আটক এবং তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া উচিত ছিল। কারণ তারা এই কাজটি আনঅফিসিয়ালি দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। নইলে আদালত কোনো বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করে বসলে তা বেআইনি হবে। তাতে সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে পারে। 

ভারতে প্রাদেশিক বাহিনীর বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১টি বাহিনী কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে অনেক দুঃসাহসিক কাজ করে আসছে। তারা তো বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানেও অংশ নিচ্ছে। তাহলে তাদের সঙ্গে এমন বঞ্চনা কেন? এটা সরকারের যথাযথ উদ্যোগ। এতে কারও আপত্তি থাকাটা উচিত নয়। নইলে এত বড় বাহিনী পোষার দরকার কী? একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে যারা আপত্তি দিচ্ছেন তাদের এবং আনসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করা। কারণ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজই তো সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা।

২০১৭ সালে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদর দফতর থেকে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে আইন সংশোধনের মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়। একটি বাহিনীর আপত্তির মুখে প্রায় সাত বছর ওই প্রস্তাবটি আটকে ছিল।

আনসার ও ভিডিপির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ ইফতেহার আলী বলেন, আনসার বাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিটের (এজিবি) সদস্যরা সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। এর আগে মার্কিন দূতাবাসের সদস্যরা সরেজমিন আমাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, সন্দেহভাজনকে তল্লাশি এবং তাকে ধরে তো পুলিশের কাছে সোপর্দের কাজটি দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছেন আমাদের সদস্যরা। এটা তো নতুন কিছু নয়। এবার আইনি বৈধতা চাওয়া হচ্ছে।

সংসদে উত্থাপিত বিলের ২১ ধারায় ‘বিদ্রোহ সংগঠন বা বিদ্রোহ সংগঠনের প্ররোচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রাখা হয়েছে। অপরাধ বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আনসার আদালত এবং বিশেষ আনসার আদালত নামে দুটি আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তি চুরি, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে প্যারেডে অনুপস্থিত থাকা, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা, দায়িত্ব পালনে অনীহা অপরাধ হিসেবে গণ্য করে চাকরি থেকে বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অপসারণের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

তবে আনসার সদর দফতর সূত্র বলছে, দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দিয়ে ২১ ধারা বাস্তবায়ন করা হলে বাহিনীর অভ্যন্তরে চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে পারে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন যুগ্ম কমিশনার বলেন, আটক এবং জব্দের ক্ষমতা আনসার বাহিনীকে দেওয়া হলে তা কখনোই ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। পুলিশের সম্পূরক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা পুলিশের জন্য বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাম্প্রতিক কর্মকান্ড : গত রবিবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রামকৃষ্ণ মিশন পূজামন্ডপ থেকে রিপা আক্তার ও মহিমা আক্তার নামে দুই চোরকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। পরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদেও তারা অপকর্মের কথা স্বীকার করে। একই দিন সকাল ১০টায় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন পূজামন্ডপ এলাকায় রফিক মিয়া (২৪) নামে একজন মোবাইল ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে থানায় সোপর্দ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত পিসি মো. কাউছার। একই দিন সকাল ১০টায় কক্সবাজার পৌরসভায় বঙ্গপাহাড় পূজামন্ডপেও হাতেনাতে এক চোরকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করে আনসার সদস্যরা। পরে তার স্বীকারোক্তিতে তার আরেক সহযোগীকে আটক করা হয়। গত রবিবার রাজশাহীর শাহ মখদুমে চতুর্বেদী সার্বজনীন মন্দিরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে অজ্ঞাত ব্যক্তি ছুরি নিয়ে মন্ডপে প্রবেশ করে। সেখানে দায়িত্বরত পিসি মো. দেলোয়ার ও তুহিন নামের আনসার সদস্যরা বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ধাওয়া দেয়। পরে সেই ব্যক্তি ছুরি রেখে পালিয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর