বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

অতিরিক্ত ফোর্স আনা হচ্ছে ঢাকায়, জরুরি ছাড়া ছুটি বাতিল

সাখাওয়াত কাওসার

প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে চলছে তল্লাশি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীতে ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করেই মহাব্যস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। নগরবাসী এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে এরই মধ্যে তাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা কষছেন নানা ছক। তবে কৌশল আরও নিখুঁত করতে পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠকে বসেছেন। সরকারের শীর্ষ মহলকে তারা আশ্বস্ত করেছেন, ষড়যন্ত্রকারীদের যে কোনো অপকৌশল ঠেকাতে তারা প্রস্তুত। সাইবার এবং মাঠের নাশকতা-দাঙ্গা দমনে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। এরই মধ্যে ডামি মহড়ায় অংশ নিচ্ছে পুলিশ। তবে বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে ‘আন্দোলনের মহাযাত্রা’র আগাম ঘোষণায় নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন রাজধানীসহ দেশের সাধারণ মানুষ। শীর্ষ কর্মকর্তারা সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা উদ্বেগে ভুগছেন। একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফোর্সে ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে ঢাকার প্রবেশপথ বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকার এমন কিছু না যে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। এটা গণতান্ত্রিক সরকার, কাজেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে। ধাক্কা দিলে সরকার পড়ে যাবে- এমন কথা সংবিধানে লেখা নেই। গতকাল সচিবালয়ে তার নিজ দফতরে তিনি এসব কথা বলেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়াই আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি। কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে তাকে আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গণগ্রেফতার ও হয়রানির বিষয়ে বিএনপির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপির উচিত সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকায় বিএনপির কয়েকটি সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও এবারে সহিংসতার আশঙ্কা করছে গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা রিপোর্ট দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েক দফা নির্ধারিত বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া র‌্যাব মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনার, ইউনিট প্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ রবিবার দিনব্যাপী পুলিশ সদর দফতরে বিশেষ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি শোডাউন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা, রাজধানীসহ সারা দেশে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়টিও সামনে এসেছে। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ছুটি বাতিল, আশপাশের জেলা থেকে বাড়তি পুলিশ আনার বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সূত্র আরও বলছে, ডিএমপির ঢাকার ৫০টি থানার ওসি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদেরও আলাদাভাবে বার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা নজরদারি শুরু করেছেন। পুলিশের সাইবার ইউনিটও তৎপর। কেউ যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য কয়েক ধাপে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্তসংখ্যক রায়ট কার, অ্যান্টিপারসোনেল কার (এপিসি), জলকামান, আর্মড ক্যারিয়ার ভ্যান, পর্যাপ্ত রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাসসহ দাঙ্গা দমনের যাবতীয় প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (উত্তর ও দক্ষিণ)-এর সদস্যরা বিশেষ মহড়ায় অংশ নেন। সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান পুলিশ লাইনে পুলিশ সদস্যদের রোলকল অনুষ্ঠানে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মামলায় বিএনপির পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে ডিএমপি ডিবির কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে। সেই সঙ্গে নতুন করে অরাজকতা করতে পারে, এমন নেতাদেরও নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দারা। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে। আজকালের মধ্যে ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় বিশেষ অভিযান, যানবাহন, বাসাবাড়ি, হোটেল ও মেসগুলোয় নজরদারির পাশাপাশি তল্লাশি চালানোর কথা রয়েছে। বিশেষ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কয়েকটি জেলা থেকে বাড়তি পুলিশ সদস্য আনা হচ্ছে ঢাকায়। পাশাপাশি রিজার্ভ পুলিশ ও র‌্যাবকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আনসারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের সবকটি ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, শাপলা চত্বরের মতো জায়গায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ করার সুযোগ নেই। কারণ জামায়াতের বিষয়ে হাই কোর্ট ও নির্বাচন কমিশনের অবজারভেশন আছে। গতকাল নিজ দফতরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপিকে যেখানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে সেখানেই সমাবেশ করতে হবে। আমরা আশা করি সেই দায়িত্বশীলতার জায়গায় তারা থাকবে।

কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সমাবেশে বসে পড়া বা নাশকতার ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য আছে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অনেক সময় রাজনীতিবিদরা এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর তাদের দায়িত্ব নিতে চান না। ফলে নগরবাসীকে নিরাপদ রাখার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষার জন্য র‌্যাব তার দায়িত্ব পালন করে যাবে। সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন সড়কে এবং মহাসড়কে রোবাস্ট পেট্রোলিং করেছি। যাতে শান্তিপ্রিয় মানুষ আরও নিশ্চিন্তে দৈনন্দিন কাজ করতে পারে। চেকপোস্ট কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। যাতে বাইরে থেকে কেউ নাশকতার মতো বস্তু নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে না পারে। একইভাবে নাশকতা পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করার কাজ করছে র‌্যাবের গোয়েন্দারা। সাইবার ওয়ার্ল্ডেও আমাদের ২৪/৭ নজরদারি আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে পুলিশের ক্রাইম কনফারেন্স থেকে নাশকতা ও দাঙ্গা দমনে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অক্টোবরের বাকি দিনগুলোয় এবং নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে চিরুনি অভিযান, ব্লক রেড অভিযান, চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি, টহল জোরদার করাসহ মাঠপর্যায়ের পুলিশকে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্টমন্ত্রী যা বললেন : গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার কোথায় বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার নেবেন। তবে জামায়াতে ইসলাম এখন পর্যন্ত কোনো নিবন্ধিত দল নয়, কাজেই তারা যদি জামায়াতে ইসলামের ব্যানারে আসে, তাহলে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

ঢাকায় প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসায়িক ও চাকরিসহ বিভিন্ন কাজে লোকজন ঢাকায় আসেন। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে অফিস-আদালত করা লোকজনও ঢাকায় আসেন। কাজেই ঢাকার পথ কেন আমরা বন্ধ করব? তারা যদি শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট স্থানে সমাবেশ করে চলে যায়, আমাদের কোনো কথা নেই, আমরা সেখানে কোনো বাধা দেব না।

বিএনপির সমাবেশ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, বিএনপি সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন কীভাবে করেছে, তা পুলিশ কমিশনার জানেন। সারা দেশে যারা বিএনপি করে তাদের সবাইকে ঢাকায় আনবেন। এত লোক ঢাকায় এলে একটা অন্য ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ জন্য তাদের কোথায় সমাবেশ করতে দেওয়া হবে এটা পুলিশ কমিশনার বুঝবেন। সেভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। বিজয় দিবস নিয়ে মন্ত্রী বলেন, মহান বিজয় দিবসে ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। সামনে নির্বাচন থাকায় জাতীয় মূল অনুষ্ঠানটি প্যারেড গ্রাউন্ডে হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি চিন্তা করেন যে প্যারেড হবে, তাহলে হবে।

সর্বশেষ খবর