শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিরপেক্ষ নির্বাচনে আইনের প্রয়োগ, আস্থা অর্জনের তাগিদ

সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে ইসির সংলাপ ♦ পরিবেশ অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন করব : সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিরপেক্ষ নির্বাচনে আইনের প্রয়োগ, আস্থা অর্জনের তাগিদ

নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে গতকাল নির্বাচন ভবনে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে আইনের প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন শীর্ষ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। তাঁরা বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করবে ইসির সক্ষমতা ও আইন প্রয়োগের সদিচ্ছার ওপর। ইসির ক্ষমতার অভাব নেই, পর্যাপ্ত আইন আছে। পর্যাপ্ত আইনের প্রয়োগ করলেই সংকটের সমাধান হবে। সেই সঙ্গে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। বক্তারা বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দেন। গতকাল নির্বাচন ভবনে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। সভায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।

এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচনি পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে নির্বাচন করব না। ঠিকমতো ভোট না হলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে আবার নির্বাচনের আয়োজন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সিইসি। গতকাল মতবিনিময় সভায় সিইসি এ কথা বলেন। সভায় সিইসির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীরসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

ইসির গতকালের মতবিনিময় সভায় ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে সাংবাদিকদের কাছে আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে পাঠানো ধারণাপত্রে দেওয়া ইসির বক্তব্যের বিষয়। এ বিষয়ে ইসির অবস্থান জানতে চান শীর্ষ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। ইসির ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য ‘প্রত্যাশিত পরিবেশ এখনো হয়ে ওঠেনি’। ইসির এমন বক্তব্যের পর ইসি নির্বাচন আয়োজন করবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা।

মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আপনারা আমন্ত্রণ করে যাবেন। তাদের (বিএনপি ও সমমনা দল) আমন্ত্রণ করেছেন, আসেনি। তারা অগ্রাহ্য করার পরও আমন্ত্রণ করে যাবেন। জনগণ আপনাদের মূল্যায়ন করবে। নির্বাচনের দিন সকালে ব্যালট পেপার ভোট কেন্দ্রে পাঠানো এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে ইসির চিন্তাকে সমর্থন দেন তিনি। সেই সঙ্গে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে ইসিকে সরে না আসার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অতীত বিতর্কের কারণে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ভোটের মতো একটা কঠিন দায়িত্ব পালন করা ইসির জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, নির্বাচন নিয়ে ইসির আস্থা ও সংকট নতুন নয়। রাতারাতি কিছু করবেন এটা কাম্য নয়। আপনারা কমিশনে একটা মেয়াদে থাকবেন। এ মেয়াদ শেষ হলে জনগণ যেন বলতে পারে, একটা কমিশন ছিল। এ উদাহরণ তৈরি করে যাবেন। যারা রাজপথে আছেন তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি করে দিতে হবে যে আপনারা ভোটে আসেন, পরিবেশ আছে।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ব্যালট পেপার সকালে আসবে কেন্দ্রে, যেটা আপনারা ঘোষণা করছেন, এটা যেন পিছিয়ে না যায়। আপনারা যেন চাপে না পড়েন, দরকার হলে ব্যালট পেপার স্থানীয় ব্যাংকগুলোয় পাঠিয়ে দেবেন। দরকার হলে ব্যালট পেপার ব্যাংকের ভল্টের মধ্যে থাকবে। ব্যাংকের ভল্টে নিরাপদে থাকবে। সেখান থেকে সকালে আপনারা ব্যালট পেপার মাঠে নিয়ে যাবেন, এটা আমার সাজেশন। তিনি বলেন, কিছুদিন পরই নির্বাচন। নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, আমাদের যে ধারণাপত্র দিয়েছিলেন সেখানে বলা হয়েছে যে অবাধ, ?নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। প্রশ্নটা হলো, এ ধরনের বক্তব্য সাংঘর্ষিক কি না? কারণ তফসিল ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে এ ধরনের বক্তব্য আসে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, এর প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আমার প্রশ্ন হলো, আপনাদের ভূমিকাটা আরও স্পষ্ট করতে হবে যে কী কারণে এখনো অনুকূল পরিবেশ হয়ে ওঠেনি।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন একটা সর্বোচ্চ ক্ষমতার জায়গায়। একটা আস্থার জায়গায়। একজন ভোটে অংশগ্রহণ করবে তখনই, যখন মনে করবে নির্বাচন কমিশন আমাদের অবাধ স্বাধীনতা দিতে সক্ষম হবে এবং ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। পরিবেশই যদি তৈরি না হয়, আপনারা কীভাবে নির্বাচনটা করবেন?

বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক বলেন, আমরা আস্থা রাখতে চাই; নির্বাচনের যদি পর্যাপ্ত আইন থাকে সেটা কার্যকর আপনারাই করবেন। আপনারাই তো যে কোনো কাউকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন। যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা কথা না শোনে তার বিরুদ্ধে তো আপনারা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সেখানে কিন্তু কোনো সংকট আমরা দেখি না। সে ক্ষেত্রে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করাটা নির্ভর করবে আপনাদের নিজেদের সক্ষমতা এবং আইনের প্রয়োগের ওপর।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে হয়তো সেই সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু ক্ষমতার তো অভাব নেই, পর্যাপ্ত আইন আছে। পর্যাপ্ত আইনের প্রয়োগ করলেই তো অনেক সংকটের সমাধান হবে। তখনই দলগুলো অবাধে আসতে সক্ষম হবে, দলগুলো যখন দেখবে আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে, আপনারা সক্ষমভাবে সবকিছু করছেন। আগেই যদি ভয় দেখিয়ে ফেলেন তাহলে তো হবে না।

দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, একটি ভালো নির্বাচন একটি নির্বাচন কমিশনকে অনেক দিন মনে রাখার জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। আগামী নির্বাচনে কমিশন এমন ভূমিকা পালন করুক যাতে আমরা সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানাতে পারি। তিনি বলেন, ইসিকে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে আপনাদের দৃঢ়তার বিকল্প নেই।

এ ছাড়া সভায় অংশ নেন : খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল, প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, এনটিভির প্রধান সম্পাদক জহিরুল আলম, বাংলাভিশনের প্রধান সম্পাদক ড. আবদুল হাই সিদ্দিক, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান রেজওয়ানুল হক রাজা, চ্যানেল আইয়ের চিফ নিউজ এডিটর জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, নিউজটোয়েন্টিফোর টিভির নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহা, চ্যানেলটোয়েন্টিফোর টিভির নির্বাহী পরিচালক তালাত মাহমুদ, বৈশাখী টিভির সাইফুল ইসলাম, দেশটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক হোসেন।

পরিবেশ অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন করব : সিইসি

সিইসি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে খুব মসৃণ ও কুসুমাস্তীর্ণ কোনো জমিনের ওপর দিয়ে চলছি না। প্রতিনিয়ত কিছু অনাস্থা, সমালোচনা হচ্ছে, সংকটের কথা চলছে। আমাদের প্রত্যাশা, আয়োজক হিসেবে সুন্দরভাবে নির্বাচন আয়োজন। সেজন্য রাজনৈতিকভাবে অনুকূল পরিবেশের আবেদন প্রথম থেকে বহাল রেখেছি এবং আজও অবধি। এক জায়গায় আমি বলেছি, প্রত্যাশা প্রথম থেকে ছিল, এখন অবধি প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশ হয়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, আন্তরিকভাবে আমরা চাই রাজনৈতিক পরিবেশ অনুকূল হয়ে উঠুক। আমাদের আরাধ্য কর্মটা সহজ হোক। সেটা আমরা প্রত্যাশা করছি।

সিইসি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার সংলাপ করেছি। সেখানে যেসব দল আসতে চায়নি, তাদের প্রতি আমাদের বিনীত আবেদন ছিল সংলাপে আসুন। সেজন্য আমরা আধাসরকারি পত্র দিয়েও অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের আলোচনায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমরা সাড়া পাইনি। আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম, আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি। তাদের রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়েছি, প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও জোটের তাদের নিজস্ব পলিটিক্যাল কৌশল থাকতে পারে, সেটা তাদের নিজস্ব ইস্যু। নির্বাচন কমিশন ওর মধ্যে অনধিকার চর্চা করবে না। আমরা নিরন্তর আহ্বান জানিয়ে যাব, আপনারা আসেন, সমস্যার সমাধান হোক অথবা মাঠে বিরাজমান সমস্যার নিরসন করুন।

দ্য ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী সিইসির কাছে জানতে চান- আপনি প্রিসাইডিং অফিসারকে বলেছেন, যদি নির্বাচন ঠিকমতো না হয় তাহলে লিভ ইট। সারা দেশে যদি নির্বাচন ঠিকমতো না হয়, তাহলে আপনি কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘না হলে নির্বাচন হবে না। পুরো দেশের নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে, আবার হবে। ওই সেন্টারে বন্ধ হয়ে যাবে, আবার করবেন। উই হ্যাভ টু বি ক্যারিজিয়াজ, উই হ্যাভ টু ডু দ্যাট।’

এর আগে সিইসি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘ভোট কেন্দ্রে সিইসি হচ্ছেন প্রিসাইডিং অফিসার। তাঁকে বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে অনিয়ম হলে তা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেবেন। না পারলে বাইরে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেবেন। তার পরও তা প্রতিহত করতে না পারলে সেখান থেকে চলে যাবেন। ওই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরে সেখানে আবার ভোট হবে।’

সর্বশেষ খবর