শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশবাসীর হাতেই সিদ্ধান্ত

সংসদে সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশবাসীর হাতেই সিদ্ধান্ত

সংসদের শেষ অধিবেশনে গতকাল বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামীতে কেমন বাংলাদেশ চান- সে সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশকে উন্নত করেছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত দেশকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। ওরা চুরি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া কিছুই জানে না। আর আওয়ামী লীগ দেশকে মর্যাদাশীল করে। উন্নত রাষ্ট্র করে। বাংলাদেশটাকে নিয়ে কেউ যেন খেলতে না পারে- এ জন্য দেশবাসীর কাছে সহায়তা চাই।

গতকাল রাতে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। পরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন সংসদের সমাপনী সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শোনান। এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি বাস্তুহারাদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা সংসদকে দেখানো হয়। গতকাল সমাপনী দিনসহ একাদশ সংসদে মোট ১৫৬টি আইন পাস করা হয়। গতকাল বিরোধীদলীয় নেতাসহ বিরোধী দল-জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের মুখেও ছিল বিদায়ের সুর। অধিবেশন শেষে সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলতে ভিড় জমান। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনাকে আবারও নাকচ করে দিয়ে দলটিকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- এই সন্ত্রাসী, জঙ্গি, এ অমানুষগুলো, এদের সঙ্গে কারা থাকে, আর তাদের সঙ্গে বসা? এই জানোয়ারদের সঙ্গে বসার কথা কারা বলে? আমার কথা হচ্ছে জানোয়ারদেরও একটা ধর্ম আছে। ওদের সে ধর্মও নাই। ওদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ নেই। ওরা চুরি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া কিছুই জানে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ছিল বলেই দেশ এগিয়ে গেছে। আর সেটাকেই ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দেশবাসীর কাছে আমি আহ্বান জানাই তারা কোন বাংলাদেশ চান। এই ধ্বংসস্তূপ? নাকি উন্নত বাংলাদেশ। তাদের জীবনমান যে উন্নত হয়েছে সেটা ধরে রাখতে চান? সেটা ধরে রাখতে হলে একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সেটা থাকবে। নৌকা মার্কা স্বাধীনতা দিয়েছে। নৌকা মার্কাই পারে উন্নত জীবন দিতে। এরা ধ্বংসই দিতে পারবে। এরা স্বাধীনতাও চায় না, উন্নতিও চায় না। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা চেষ্টা করছি। এটা করতে পারব। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক, উন্নয়নের অগ্রগতি অব্যাহত থাকুক, অধিকার সুরক্ষিত থাকুক সেটা আমরা চাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই? দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আমরা উন্নত করেছি। বলেছিলাম দিনবদলের সনদ। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আর তখন এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ। আমার আজ বক্তব্য দেওয়ার মানসিকতা নেই। তিনি বলেন, এরকম দৃশ্য। যারা জাজের বাড়িতে আক্রমণ করে। এটা তাদের অভ্যাস। এর আগে প্রধান বিচারপতির অফিসে লাথিও মেরেছে বিএনপি নেতারা। পুলিশের ওপর হামলা, অ্যাম্বুলেন্সে রোগী যাচ্ছে সেখানেও আক্রমণ। আর কি বীভৎস দৃশ্য। পুড়িয়ে মানুষ হত্যা না শুধু, মনে হচ্ছে এরা পুরো দেশটাকে ধ্বংস করবে। তিনি বলেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে কে কোন দল করে সেটা আমি দেখিনি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছি। তাদের জন্য কাজ করেছি। তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, আমরা যখন দেশের মানুষের উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তখন বিএনপি-জামায়াত জোট বারবার অগ্নিসন্ত্রাস, সংঘাত, মানুষ হত্যা, মামলা নানাভাবে মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। একদিকে আমরা দেশের জন্য কাজ করি। দেশের উন্নতি করি অন্যদিকে তারা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ধ্বংস করাটাও তাদের চরিত্র। ২৮ তারিখে যেভাবে পুলিশকে ফেলে দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, কোনো মানুষ এরকম করতে পারে? ২০১৩, ’১৪ ও ২০১৫ সালে তারা একইভাবে করেছে। মাঝখানে একটু থেমেছিল তারপর আবার ভয়ংকর রূপ জাতি দেখছে। এ সময় বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও দুর্বৃত্তপনা রুখে দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশটাকে নিয়ে কেউ যেন খেলতে না পারে- এ জন্য দেশবাসীর কাছে সহায়তা চাই। দেশবাসীকে বলব অগ্নিসন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দিন। আপনার গাড়ি পোড়ালে এদের ধরে ওই আগুনে ফেলুন। যে হাত দিয়ে গাড়ি পোড়াবে সেই হাত পুড়িয়ে দিন। তাহলে ওরা থামবে। তা না হলে ওরা থামবে না। এটা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করতে হবে। দেশের মানুষের সহযোগিতা পেলে এদের দুর্বৃত্তপনা কমানো যাবে। মানুষকে বলব ভয়ের কিছু নেই। এরা মুষ্টিমেয়। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপির চলমান আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবস্থা যখন আমরা করে যাচ্ছি তখন কী দেখলাম? কথা নেই, বার্তা নেই- নির্বাচন হতে দেবে না। আর আমাকে পদত্যাগ করাবে। ক্ষমতা থেকে হটাবে। ঘোষণা দিয়ে ২৮ অক্টোবর বিএনপি যে তান্ডব করছে সারা বাংলাদেশে...। এ দৃশ্যগুলো সহ্য করা যায় না। সাংবাদিকরা কী অপরাধ করেছে? আর এরাও বিএনপিরই কাজ করত। তাদের যেভাবে মেরেছে! যারা ক্ষতিগ্রস্ত তার পাশে আছি। সাধ্যমতো সাহায্য করে যাচ্ছি। দেশবাসীর সহযোগিতা চেয়ে তিনি আরও বলেন, এই দুর্বৃত্তরা সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করছে। সাংবাদিক, পুলিশ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। সম্পদ নষ্ট করছে। শেষ অধিবেশনে আমার বক্তব্যে এইটুকু আহ্বান জানাব-জনগণ হচ্ছে শক্তির উৎস। আমার একমাত্র শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের শক্তি নিয়েই আমরা চলছি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ২৮ অক্টোবরে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের একটি ভিডিওচিত্র সংসদে প্রদর্শন করেন।

সংসদ নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান তো আমার বাবা মা ভাইবোন সব হত্যার সঙ্গে জড়িত। আর খালেদা-জিয়া, তারেক জিয়া তো আমাকে হত্যার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মী হত্যা করেছে। তাঁকে বিদেশে হত্যার চেষ্টা হয়েছে সেই অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বার বার আমার ওপর আঘাত হেনেছে। তারপর আমি বেঁচে গেছি। এখনো বার বার আমার ওপর হামলা হচ্ছে। এমনকি বিদেশেও আমার ওপর হামলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আমি বিস্তারিত বলব না। শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখলাম। আমি যখন বিদেশ যাই সেখানেও কিলার হায়ার করে আমাকে মারার চেষ্টা... সে চেষ্টাও ওই খালেদা জিয়ার ছেলে যেটা লন্ডনে বসে আছে। সেসহ যারা সন্ত্রাসী তারাই।

তবে আমি কখনো এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না। জন্মালে তো মরতে হবে। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস আছে এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাব।

বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। এ সংক্রান্ত ছোট একটি পুস্তক সংসদ সদস্যদের কাছে সরবরাহ করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যখাত, বাজেট বৃদ্ধি, জিডিপির আকার বৃদ্ধি, শিক্ষাখাত, এডিপি, দারিদ্র্যবিমোচন, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি, ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বৃদ্ধি, সরকারি সেবা সহজীকরণ, সামাজিক সুরক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কথা জানান। রিজার্ভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রিজার্ভ সময়ে সময়ে বাড়ে কমে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ আমরা খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে অন্য কাজগুলো করে যাচ্ছি। আমরা সবসময় খুব সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১ হাজার ৪৬২ টাকা। আমরা তিন দফায় বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি জিনিসপত্রের দাম নিয়ে অনেকে হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু আমরা এই যে উৎপাদন বাড়ালাম। জনসংখ্যা কিন্তু এতগুণ বাড়েনি। তাহলে এগুলো গেল কোথায়? মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। খাদ্যগুণ বেড়েছে। সেটাই হলো বড় কথা। দেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে।

সংসদ নেতা বলেন, বিরোধী দল ও আওয়ামী লীগের এমপিরা সংসদে এসেছেন। যথাযথ আলোচনা করেছেন। এই সংসদে অনেকজন সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি। এই সংসদে ১৬৫টি আইন পাস করা হয়েছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা প্রতিটি বিলের ওপর আলোচনা করেছেন। সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দলের সদস্যরা বেশি আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন। বিশেষ অধিবেশন ৮ নভেম্বর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদযাপন করেছি। এ উপলক্ষে ২৫ নভেম্বর ২০২১ সালে বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি বিশেষ অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিয়েছেন।

স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনার নেতৃত্বে করোনার সময়েও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আমরা সংসদ অধিবেশন চালিয়েছি। বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়ন করেছি। যে কারণে দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ করতে সক্ষম হয়েছি। এ জন্য সবাই সহযোগিতা করেছেন। আমরা দেশের উন্নতি করি, তারা (বিএনপি) ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ২৮ তারিখেও তারা পুলিশকে হত্যা করেছে। একইভাবে ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

সর্বশেষ খবর