শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাংবাদিক নির্যাতন পুলিশ খুনে শাস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ঢাকায় ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ থেকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পুলিশ হত্যা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি পেতেই হবে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত প্রতিনিধি       সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় পৌঁছালে ফুল দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। শেখ হাসিনা আরও বলেন, যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে অমানবিক এবং ন্যক্কারজনক। এত অমানবিক আচরণ একটা রাজনৈতিক দলের হয় না। এগুলো আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরে তাদের আসল চেহারা সামনে নিয়ে আসতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এ সময় দশম ওয়েজবোর্ড গঠন, সাংবাদিকদের আবাসনের ব্যবস্থা এবং কল্যাণ তহবিলে ১০ কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। অনেক মিডিয়ায় নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে মিডিয়া মালিকদেরও এই কল্যাণ ট্রাস্টে অনুদান দেওয়ার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সমাবেশের নামে ২৮ অক্টোবরের সাংবাদিক নির্যাতন ও পুলিশ হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, সাংবাদিকদের মাটিতে ফেলে পেটানো আমার মনে হয় বাংলাদেশে এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা আর দেখা যায়নি। এর জবাব বিএনপিকে দিতে হবে। আমি সাংবাদিকদের এতটুকুুই বলব- এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যেগুলো ঘটে গেছে এবং দায়িত্ব পালনকালে আপনাদের ওপর যারা আক্রমণ করেছে তাদের আসল চরিত্রটা আন্তর্জাতিকভাবে আপনাদের তুলে ধরা উচিত। আমাদের কোনো কোনো পত্রিকা দেখলাম এটাকে আবার কভার দেওয়ারও চেষ্টা করে। তাদের ধিক্কার জানাই। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছেও আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তাঁর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করেছে, যেখানে রেল সংযোগও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট  দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। বিএফইউজে সভাপতি ওমর ফারুক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সহসভাপতি মধুসূদন মন্ডল শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। পরে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দীপ আজাদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। বিএফইউজের সাবেক সভাপতি ও মহাসচিবদের অনুষ্ঠানে সম্মাননা প্রদান করা হয়। বর্ষীয়ান সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, আবদুল জলিল ভূইয়া, শাবান মাহমুদ এবং ওমর ফারুক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পর্বে বিকাল ৩টায় একই স্থানে দেশের সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি সম্মেলনে ১৩টি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং একটির সাধারণ সম্পাদক বক্তৃতা করেন। তাঁরা হচ্ছেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি আবদুস সালাম খোকন, ময়মনসিংহ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আতাউল কবির খোকন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুল ইসলাম, বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন শেখ মিন্টু, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মো. আবু তাহের, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি ফারুক আহমেদ, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মনতোষ বসু, কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব, রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম, দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি ওয়াহিদুল ইসলাম, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি স্বপন খন্দকার, গাজীপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি আতাউর রহমান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি দীপক চৌধুরী।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন দাবি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেক মিডিয়ায় নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। সাংবাদিকদের জন্য নতুন দশম ওয়েজবোর্ড ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া আগামীতে জেলায় জেলায় সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য প্লট বরাদ্দের পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের নামে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের এ দেশে কোনো অধিকার নেই। তারা মানুষের কল্যাণ বা এ দেশের কল্যাণ চায় না। আন্দোলন আমরাও করেছি। আন্দোলনের নামে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করা হয়, সেটি দুঃখজনক। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের মাটিতে ফেলে পেটানো আমার মনে হয় বাংলাদেশে এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা আর দেখা যায়নি। এর জবাব বিএনপিকে দিতে হবে। সেদিন প্রেস স্টিকার লাগিয়ে যুবদল কর্মীর সন্ত্রাস ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে যারা এ ধরনের ঘটনা করেছে তারা ধরা পড়ে গেছে। সাংবাদিক নির্যাতন-পুলিশ হত্যার শাস্তি এ দেরকে পেতেই হবে। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, একটা জমির আবেদন দিয়েছেন আমি দেখব। জেলাভিত্তিক আবাসন প্রকল্প তৈরি করে দেব। সেখান থেকে আপনারা আবাসন যাতে পান, সে ব্যবস্থা করব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা উচ্চমানের। এ পেশা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আছে। আমি সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে আরও ১০ কোটি টাকা অনুদান দেব। মালিকরাও কিছু কিছু দিয়েন। কারা দিলেন আমরা কিন্তু দেখব। তিনি বলেন, মালিকরা কেন কল্যাণ ট্রাস্টে অনুদান দেন না? না দিলে বন্ধ করে দিতে পারি। করতে চাই না। কিন্তু ব্যবস্থা আছে। কল্যাণ ট্রাস্টে ফান্ড দেবে, তারপর চলবে। এখানে অনেক মালিক আছেন তো তাই বললাম। দেখি ভয় পেয়ে কিছু দেয় নাকি! ওয়েজবোর্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন মালিকদের দায়িত্ব। সেটা বাস্তবায়ন না করে মামলা করলে তা দুর্ভাগ্যজনক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দশম ওয়েজবোর্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেটা আমরা দেব। টেলিভিশনের সাংবাদিকদেরও আমরা ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনব। অনেক সময় আপনাদের মধ্যে নানা মতের কারণে অনেক কিছু সময়মতো করা যায় না, এটায় আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডে নিয়ে আসতে হবে। সামনে ওয়েজবোর্ড গঠনে মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সাংবাদিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছি। এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে অসুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা দিয়ে থাকি। আজ এখানে আসার আগেও কিছু ফাইল দেখে এসেছি, সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন সদস্য উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা নিজেও সাংবাদিক ছিলেন। যার কারণে আপনাদের মাঝে এলে আমি দাবি করি, আমি আপনাদেরই পরিবারের একজন। সাংবাদিক কলাকুশলীদের যাতে কর্মসংস্থান হয়, সবকিছু বেসরকারিভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। তথ্য অধিকার আইন, তথ্য কমিশন ও জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ফিরে এসেছিলাম এমন একটি দেশে, যেখানে আমি আমার বাবা-মার হত্যার বিচার চাইতে পারব না। ইনডেমনিটি দিয়ে সেটির পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। যে আদর্শ নিয়ে এ দেশের মানুষ জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এনেছে, সেটি বৃথা যেতে পারে না। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমি এসেছি। আমাদের প্রচেষ্টা দেশের মানুষের জন্য কাজ করা।

প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা দেশে ফিরে যখন দেশের শাসনভার হাতে নেন, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার সবরকম পদক্ষেপই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে সাংবাদিকদের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন। সেই সংবিধানে ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিল, চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংবিধান বা রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অধিকার দেবে। সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। সেই সঙ্গে জাতির পিতা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩, নিউজ পেপার এমপ্লয়িজ অ্যাক্ট ১৯৭৪, প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪, নিউজ পেপার অ্যাক্ট ১৯৭৫, চলচিত্র সেন্সরবোর্ড অ্যাক্ট ১৯৭২- এ আইনগুলো করে দিয়ে যান। কারণ তিনি নিজেও রাজনৈতিক জীবনে, উনি যে চাকরি করেছেন, সাংবাদিকতাতেও তিনি সংযুক্ত ছিলেন। সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের দেশে এখন মানুষ যত না বেশি সংবাদপত্রের পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক উন্নত দেশ, ধনী দেশেও মনে হয় এত সংবাদপত্র নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে পত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২৪১টি, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়াভুক্ত ৭০৪টি, নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল ৩৮৭টি। কর্মসংস্থানটা, এটাই আমার লক্ষ্য।

বাংলাদেশকে মুক্ত গণমাধ্যমের দেশে পরিণত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সাংবাদিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। সাংবাদিক সহায়তা কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমরা সাংবাদিক সহায়তা, ভাতা ও অনুদান নীতিমালা ২০১২ এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৪ প্রণয়ন করে একটা ট্রাস্ট বোর্ড গঠন করে এবং সেই সঙ্গে এটা পরিচালনার জন্য একটা সিড মানিও আমরা দিয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আজ বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল এখন অনেকটা সাশ্রয়ী হয়েছে। টেলিভিশন মালিকরা তাদের বলব, আগে স্যাটেলাইট ভাড়া করা হতো বিদেশ থেকে। সেখানে বৈদেশিক মুদ্রায় ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে হতো। আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি, সেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমেই কিন্তু সবাই টেলিভিশন চালাচ্ছে, ভাড়াটাও কম- খুব বেশি না। এত বড় একটা সাশ্রয় করে দিলাম।

সর্বশেষ খবর