শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গভীর সংকটে গার্মেন্ট

এক সপ্তাহে ৪০০ কারখানা বন্ধ, গত ১০ মাসে বন্ধ হয়েছে ৩১২টি, বেকার হতে পারেন ৪০ লাখ শ্রমিক, আজ থেকে কাজে ফেরার আহ্বান মালিকদের

শাহেদ আলী ইরশাদ

গভীর সংকটে গার্মেন্ট

গভীর সংকটে গার্মেন্ট। গত কয়েক দিনে শ্রমিক আন্দোলনের মুখে বন্ধ হয়েছে ৪ শতাধিক কারখানা। আর নানা সংকটে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বন্ধ হয়েছে ৩১২টি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেকার হতে পারেন পোশাক খাতের ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক। যা অর্থনীতির জন্য হুমকি। পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, মজুরি নির্ধারণে অনেক দিন ধরে আলোচনা হলেও কয়েক দিন ধরে শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন। এর পেছনে বাংলাদেশবিরোধী একটি চক্রের ইন্ধন থাকতে পারে। এটি দুঃখজনক। আজ শনিবার থেকে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া উচিত। শ্রমিকরা দাবি করেছেন বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে ন্যায্য মজুরি।

জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে চলমান সহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ৪ শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার থেকে কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস পাওয়ার পর বন্ধ কারখানা আজ শনিবার খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ। এ বিষয়ে বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২৩ অক্টোবর থেকে চলমান শ্রমিক আন্দোলনের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারখানার মধ্যে কিছু কারখানা আছে, যেগুলোতে কোনো সমস্যা না থাকলেও পাশের কোনো কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ভয়ে নিজের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।

ফারুক হাসান বলেন, আজ শনিবার কারখানা খোলার পর যদি আবারও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় তাহলে মালিকপক্ষ তৎক্ষণাৎ কারখানা বন্ধ করে দিতে পারবে।

পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে চলতি বছরের এপ্রিলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ সভায় শ্রমিকদের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন। তার বিপরীতে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেন। পরদিন থেকেই গাজীপুরে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। পরে আশুলিয়া-সাভারেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ অক্টোবর দুজন শ্রমিক মারা যান। ২৪ অক্টোবর আন্দোলন আরও সহিংস হয়ে উঠলে বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, মালিকরা চাইলে কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। তারপরই কারখানা বন্ধ করে দেন মালিকরা। এদিকে শ্রমিক আন্দোলনের মুখে ১০ হাজার ৪০০ টাকার পরিবর্তে নতুন মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ। যদিও কত টাকার প্রস্তাব হবে, সেটি তারা জানাননি। তবে চলতি বছরের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে মজুরি চূড়ান্ত হবে বলে মালিকরা জানিয়েছেন। ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন হবে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ২৫ অক্টোবরের সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, মালিক এবং সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরও শ্রমিকরা কাজে না ফিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। ফলে এসব কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না। এতে তৈরি পোশাক খাতের ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হতে পারেন। তাতে হুমকিতে পড়বে শ্রমিকদের পরিবারও।

শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শিল্প পুলিশ-এলাকার ৩১২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে ৬০টি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্য, ১৬টি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য, ৯টি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমইএ) সদস্য এবং পাঁচটি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সদস্য। বাকি ২২৩টির বেশির ভাগই কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান (নন-আরএমজি)। বন্ধ পোশাক কারখানাগুলোতে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মী কাজ করতেন। বিজিএমইএর সদস্য ৬০টি কারখানায় কাজ করতেন ১৬ হাজার ৯৪৩ জন কর্মী। নন-আরএমজি কারখানাগুলোতে নিযুক্ত ছিলেন ১৬ হাজার ১৭৩ জন কর্মী।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ অথবা ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ শতাংশ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে শীর্ষ ছয় খাতের মধ্যে শুধু তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। কারখানা বন্ধ থাকায় সময়মতো পোশাক রপ্তানি ব্যাহত হলে কমে যাবে আয়ও।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম এ মান্নান কচি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করতে একটি চক্রের ইন্ধন রয়েছে। যারা বাংলাদেশ থেকে ক্রেতাদের অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে দেশি-বিদেশি একটি চক্র। কারও প্ররোচনায় না পড়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বিজিএমইএর এই নেতা বলেন, ১৫ নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি নির্ধারণ হবে। ডিসেম্বরে শ্রমিকরা নতুন বেতন পাবেন। আমরা সব সময় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানের পক্ষে। পোশাক খাত টিকে থাকলে শ্রমিকরা বাঁচবে। পোশাক খাত না থাকলে শ্রমিকরা কোথায় যাবে। তাই আমি আশা করব শ্রমিকরা আজ থেকে কাজে ফিরবে।  

এ বিষয়ে মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য কখনোই কাম্য নয়। চলমান পরিস্থিতিতে শ্রম আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুশীল সমাজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই মজুরি বোর্ডে ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ ২৩ হাজার, কেউ ২৫ হাজার টাকার দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের নামে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার বানানো হচ্ছে। একজন শ্রম আন্দোলন কর্মী হিসেবে বর্তমান আন্দোলন সমর্থন করি না। শ্রমিকদের উদ্দেশে রনি বলেন, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দিন। বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে ন্যায্য মজুরি আদায় করা হবে।

মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রস্তাবে সব সময় কিছুটা পার্থক্য থাকে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা ও শিল্প-উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট সামনে রেখে আমরা এ প্রস্তাবনা করেছিলাম গত সভায়। সবকিছু বিবেচনা করে মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা মজুরি বৃদ্ধি করব। চলতি মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। ডিসেম্বরে নতুন কাঠামোতে শ্রমিকরা বেতন পাবেন।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের অন্যান্য বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের যে বেতন ২৩-২৪ হাজার। সেখান থেকে কমিয়ে দিয়েই বেতন চেয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা। মালিকদের উচিত শ্রমিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে একটি ফলাফলে আসা।

সর্বশেষ খবর