মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মালিক-শ্রমিক মিলেই গার্মেন্ট রক্ষা

সংঘাত নয়, আলোচনায় সমাধান - বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

শাহেদ আলী ইরশাদ, জয়শ্রী ভাদুড়ী ও রাশেদ হোসাইন

মালিক-শ্রমিক মিলেই গার্মেন্ট রক্ষা

গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তৈরি পোশাক শিল্প খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ৫ কোটি মানুষ জড়িত। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের সবচেয়ে বড় খাত এটি। পোশাক কারখানাগুলোয় যে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটেছে এর সঙ্গে কোনো শ্রমিক বা শ্রমিক সংগঠন জড়িত নয়। হামলাকারীরা সবাই বহিরাগত। দেশের স্বার্থে মালিক-শ্রমিক মিলে এ খাত রক্ষা করতে হবে। সংঘাত নয়, শ্রমিকদের বেতনভাতাসহ সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। আগামীকাল (আজ) নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার সুখবর আসবে।

গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত ‘পোশাক খাতে সংকট : সমাধান কোন পথে’ শীর্ষক গোলটবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স রুমে এ গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, নিম্নতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম, বিকেএমইএ’র নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম, বিটিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট সালেউদ জামান জিতু, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি ও নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি, বিজিএমইএ’র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মহসীন উদ্দিন আহমেদ নীরু, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আকতার, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম ও গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সবুজ। শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, পোশাক তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ভূরাজনীতির কারণে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ অনেক বেশি। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটে শ্রমিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হচ্ছে, যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সংকটময় সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে ৫ কোটি মানুষ জড়িত। দেশের স্বার্থে এ সেক্টরকে সবাই মিলে রক্ষা করতে হবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মালিক-শ্রমিকদের একসঙ্গে দলগতভাবে কাজ করতে হবে। তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সহিংসতা পরিহার করতে করতে হবে। ভাঙচুরের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব না। আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব সবকিছুর সমাধান। প্রতিযোগিতা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। ধৈর্য ধরে সমাধানের পথ বের করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিক ভাই-বোনেরা এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি। কারণ ভাঙচুর সংকটের সমাধান নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সংকটের সমাধান নয়। দাবি নিয়ে দরকষাকষি করতে হবে। মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষ মিলেই আমাদের পোশাক খাত রক্ষা করতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে, আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বার্থে ইতিবাচক একটা অধ্যায়ের পক্ষে আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশনবিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা একাধিক গার্মেন্ট সংগঠন শ্রমিকদের আন্দোলনের উসকানি দিচ্ছে। কারখানা ভাঙচুর করলে মামলা করা যাবে না, এটা হতে পারে না। নৈরাজ্যকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কারও কাম্য নয়। ভাঙচুরের সঙ্গে যারা জড়িত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বহিরাগত বা রাজনৈতিক ইস্যু বা এনজিও দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামানো হচ্ছে। বেতন নির্ধারণের আগে এ ধরনের আন্দোলন কখনো হয়নি। আগামীকাল (আজ) একটি সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি জানান। বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, মজুরি বাড়ার সিদ্ধান্তের আগেই ফ্যাক্টরি ভাঙচুর করা হচ্ছে। কভিড ও বিশ্বমন্দার কারণে নানা সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে পোশাক মালিকদের। পাঁচ বছর পর পর বেতন রিভিউ করার কারণে প্রতি বছর নির্বাচন সামনে রেখে কারখানাগুলোয় সংকট তৈরি হয়। তাই মালিকপক্ষ চার বছর বা ছয় বছর করার প্রস্তাব করবে। বিকেএমইএ’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সক্ষমতা বিবেচনা করেই বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে বেতন নির্ধারণ করলে হবে না, ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমিক আন্দেলন জ্বালাও-পোড়াও বিশ্বাস করে না। একটি গোষ্ঠী তাদের নামতে বাধ্য করছে শ্রমিকদের ক্ষুধা কাজে লাগিয়ে। আমাদের দাবি পরিষ্কার, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। যারা কারখানা ভাঙচুর করছে তারা কেউ শ্রমিক নয়। এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে কোনো শ্রমিক সংগঠন জড়িত নয়। বিজিএমইএ’র সাবেক সহসভাপতি মহসীন উদ্দিন আহমেদ নীরু বলেন, শ্রমিক-মালিক মিলেই গার্মেন্ট শিল্প। বেতন কাঠামো নির্ধারণ আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে, সংকট কাটাতে সময় প্রয়োজন। আন্দোলনের সঠিক সময় এখন নয়। দেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সময় এ ধরনের আন্দোলন করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। বিটিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট সালেউদ জামান খান জিতু বলেন, ধ্বংসাত্মক আগুন জ্বালাও শ্রমিকের কাজ হতে পারে না। শ্রমিক নেতারা বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখবেন। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা কোথায় যাবে? ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হবে। গুজব ছড়িয়ে শ্রমিকদের যেন ভুল মেসেজ ও উসকানি না দেওয়া হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আকতার বলেন, বেতন কাঠামোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যগতসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে কারখানায়। আন্তর্জাতিক মার্কেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতনভাতার কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। মালিক-শ্রমিক মিলে এ সেক্টরটি রক্ষা করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা ও বিপুল পরিমাণ নারী শ্রমিককে সুরক্ষা দিতে হবে। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ২৩ হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ জরুরি। সবকিছুর পরিবর্তন হলেও শ্রমিকের জীবন ও জীবিকার পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলন দমাতে পুলিশ গুলি করে শ্রমিক হত্যা করে। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা শ্রমিকদের পিটিয়েছে, এটা কখনো কাম্য না। শ্রমিকদের কথা বলার কোনো অধিকার রাখা হয়নি। শ্রমিকদের ঠকাতে নানাভাবে কাজ করছে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সবুজ বলেন, শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে উচ্ছিষ্ট মাছ, সবজি কিনে জীবনযাপন করে শ্রমিকরা। দৈনন্দিন খরচ কুলাতে না পেরে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম বলেন, সংকটের কথা চিন্তা করলে শ্রমিক আন্দোলন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে আমাদের পোশাক খাত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের এ সেক্টর রক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর