বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষ

নারী শ্রমিক নিহত, পুলিশসহ আহত ২৩ নতুন মজুরি ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি

গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষ

গাজীপুরে গতকাল শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ছুটির পর গতকাল বিকালে মহাসড়ক অবরোধ করে ফের বিক্ষোভ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা। শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।

মহাসড়কে অবস্থান নেওয়ায় দুই মহাসড়কেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশের বিভিন্ন কারখানায় ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। খবর পেয়ে থানা ও শিল্প পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। 

গতকাল সকাল থেকে ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী, জরুন, বাইপাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকরা। কোনাবাড়ীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আঞ্জুয়ারা খাতুন (২২) নামের এক নারী পোশাকশ্রমিক নিহত হন। পুলিশসহ আহত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন। দিনভর সংঘর্ষে বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ বলছে, শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের আটজন সদস্য আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শর্টগানের গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। জানা গেছে, আঞ্জুয়ারা কোনাবাড়ি জরুন এলাকার ইসলাম গার্মেন্টস ইউনিট-২ এর সেলাই মেশিন অপারেটর পদে চাকরি করতেন। তিনি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ এলাকার জামাল হোসেনের স্ত্রী। তিনি জরুন এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। এক ছেলে এক মেয়ের মা তিনি। ওই নারী শ্রমিককে প্রথমে গুরুতর অবস্থায় দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া বলেন, কোনাবাড়ি থেকে আহত দুজনকে হাসপাতালে আনা হলে বেলা সাড়ে ১২টায় আঞ্জুয়ারা খাতুনকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। জালাল উদ্দীন (৪২) নামে একই গার্মেন্টসের সুপারভাইজার গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলেও তিনি জানান। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জালাল উদ্দিন জানান, তিনি ইসলাম গার্মেন্টসের সুপারভাইজার। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন। প্রথমে উদ্ধার করে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান এই পোশাকশ্রমিক। নিহত আঞ্জুয়ারা বেগমের ননদ আরজিনা বেগম জানান, কোনাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন আঞ্জুয়ারা। আঞ্জুয়ারার স্বামী জামাল বাদশা জানান, তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। আঞ্জুয়ারার মৃত্যুতে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। বারবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখন আমার সন্তানদের কে দেখবে।’ পুলিশ, শ্রমিক ও এলাকাবাসী জানান, মঙ্গলবার পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা বোর্ডের সভা শেষে ঘোষণা করা হয়। মজুরি বোর্ড ঘোষিত শ্রমিকদের বেতন প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শ্রমিকরা। গতকাল সকাল থেকে কোনাবাড়ি এলাকার স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, রিপন নিটওয়্যার লিমিটেড, ইসলাম গার্মেন্টস ও বেস্টঅল সোয়েটারসহ আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার সামনেই বিক্ষোভ শুরু করলে কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের জরুন ও বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার সামনেই বিক্ষোভ শুরু করেন। সকাল ৮টায় কাশিমপুরের জরুন মোড়ের সামনে একত্রিত হয়ে হাতে ইট এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করতে থাকেন। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেট নিক্ষেপ করে। এরপর শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ উদ্দিন জানান, শ্রমিকরা আঞ্চলিক সড়কগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এ সময় তারা ভাঙচুরের চেষ্টা করে। শ্রমিকদের মহাসড়কে উঠতে দেওয়া হয়নি। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।

দুপুরের পর ফের আন্দোলনে শ্রমিকরা : পুলিশের গুলিতে শ্রমিক হতাহত হওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা। গাজীপুরের কারখানাগুলোয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা গাড়িসহ বিভিন্ন কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে। এ সময় তারা মিছিল বের করে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাওজোড় এলাকায়ও পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হন। পরে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র‌্যাবও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিকাল ৪টায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকরা। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কের দুই পাশের কারখানায় ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করতে থাকেন। খবর পেয়ে থানা ও শিল্প পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মাহবুব আলম জানান, শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় আট পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সকালে তিনজন এবং বিকালে নাওজোড় এলাকায় পাঁচজন আহত হন।

এদিকে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে নগরের কোনাবাড়ী ও জরুন এলাকায় কিছু কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

আমাদের সাভার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল সকাল ৭টায় ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া ও নিশ্চিতপুরে বিক্ষোভ করেন পোশাকশ্রমিকরা। এ ঘটনায় নারী ও পুরুষসহ ২০ জন আহত হন। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজামান বলেন, শ্রমিকদের শান্ত থাকতে অনুরোধ করা হলে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিয়ারশেল ছুড়লে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

পোশাকশিল্পে ডিসেম্বর থেকেই ঘোষিত নতুন মজুরি বাস্তবায়ন করবে বিজিএমইএ : পোশাক শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী ৭টি গ্রেডের জায়গায় ৫টি গ্রেড করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ানো বহাল রয়েছে। নতুন মজুরিতে মোট বেতনের তুলনায় মূল বেতন আনুপাতিকভাবে বেশি বাড়ানো হয়েছে। ফলে শ্রমিকরা অনুপাতিকভাবে বোনাস ও অন্যান্য ভাতা বেশি পাবেন। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নিম্নতম মজুরি বোর্ড নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করার পর বেশকিছু কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনরা ধর্মঘট করছেন, কারখানা ভাঙচুর করছেন, যা অনভিপ্রেত। শ্রমিক ভাইবোনদের প্রতি আমার অনুরোধ, এমন কিছু করবেন না যাতে শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়-ক্রেতাদের আস্থা বিনষ্ট হয়। আপনাদের অবদানেই শিল্প বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ক্রেতারা শিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আপনারা কর্মহীন হয়ে পড়বেন, যা কাম্য নয়। দেশ ও শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিক ভাইবোনদের কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে, যদি কোনো কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান, তবে মালিকরা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। আমি আশা করি, আজ থেকে শ্রমিক ভাইবোনরা যথারীতি নিয়ম মেনে কারখানায় কাজ করবেন।’

সর্বশেষ খবর