রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এক দিনে ১৩০ কারখানা বন্ধ

ঢাকায় বিক্ষোভ, গাজীপুরে ১২৩ কারখানায় ভাঙচুর, ২২ মামলায় গ্রেফতার ৮৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর ও সাভার প্রতিনিধি

এক দিনে ১৩০ কারখানা বন্ধ

ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গতকালও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন পোশাক শ্রমিকরা। ঢাকায় মিরপুর ১৩ নম্বরের ভিশন, এমবিএম, লোডস্টার, সারোজ গার্মেন্টসহ আশপাশের ১০টি গার্মেন্টের শ্রমিকরা এ বিক্ষোভে  অংশ নেন। এদিকে মজুরি বোর্ড ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা প্রত্যাখ্যান করে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় ১৩০টি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষে এ পর্যন্ত ১২৩টি কারখানায় কমবেশি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলায় এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৭টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। গতকাল বেলা ২টায় মিরপুর ১৩ নম্বরের প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন কয়েক শ’ গার্মেন্ট শ্রমিক। বিক্ষোভে অন্তত ১০টি গার্মেন্টের শ্রমিকরা অংশ নেন। বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা জানান, ‘তাদের বেতন ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে তারা রাস্তায় নেমেছেন। নতুন যে বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে তা তারা মানেন না।’ শ্রমিকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না পারে, সেজন্য আশপাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ডিএমপির কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুকুল আলম বলেন, দুপুরে পোশাক শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর            দাবিতে রাস্তায় নেমে পৌনে এক ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছে। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা প্রত্যাখ্যান করে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় ১৩০টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। বন্ধের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। গতকাল সকালে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, ছয়তলা, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর ও জিরাবো-বিশমাইল সড়কের কাঠগড়া আমতলা, বড় রাঙ্গামাটিয়ার বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ পোশাক কারখানার গেটে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে কারখানা বন্ধের নোটিস। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিংবা কারখানা খোলার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে তা নোটিসের মাধ্যমে জানানো হবে।’ আগামী অ্যাপারেল্স লিমিটেড কারখানার নোটিসে বলা হয়, ‘গত ৩০ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকরা কারখানায় এসে ফেইস পাঞ্চ করে। তারা কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখে চিৎকার চেচামেচি করে। পরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পর কারখানা ত্যাগ করে বাইরে চলে যায়। এতে করে নিরুপায় হয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু বেতনের আগ পর্যন্ত ৫ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে যায়। বেতন হয়ে গেলে ৮ নভেম্বর আবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি করে শ্রমিকরা। সাধারণ শ্রমিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে মিছিল করতে করতে কারখানা গেটে চলে যায়। এমতাবস্থায় আবারও কর্তৃপক্ষ কারখানা ছুটি দিতে বাধ্য হয়। তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানার সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ৯ নভেম্বর কারখানা বন্ধ রাখে। এমন কার্যকলাপ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খলতা ও বে-আইনি ধর্মঘটের শামিল। তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ১১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৩(১) ধারা মোতাবেক অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করল।’  কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ার বিষয়টি শ্রমিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও জানিয়ে দিচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। অ্যাপারেলস কারখানার এক শ্রমিক নিলুফা বেগম বলেন, ‘শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনের মুখে কারখানা কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে। আমাদের মোবাইলে এ সংক্রান্ত মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া কারখানার গেটে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা অনেকেই কারখানায় সকালে গিয়ে নোটিস দেখে ফিরে এসেছি। কারখানা কর্তৃপক্ষ যে আইন দেখিয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে সেই আইনে কারখানা যতদিন বন্ধ থাকবে ততদিনের বেতন পাবে না শ্রমিকরা।’  এদিকে, আশুলিয়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনায় ৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী ভুক্তভোগী কারখানা কর্তৃপক্ষ। এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের মুখে প্রায় ১৩০টি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের কারখানা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো চিঠি দেয়নি। তবে বিভিন্নভাবে আমরা বন্ধের খবর পেয়েছি।  এদিকে, গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষে ১২৩টি কারখানায় কমবেশি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। পোশাক কারখানায় হামলা, ভাঙচুর, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা প্রদানের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৮৮জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৭টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষনা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। গতকাল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়িতে শ্রমিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত তুসুকা পোশাক কারখানা পরিদর্শনে এসে এসব কথা বলেন শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোকে কেন্দ্র করে এখানে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। শ্রমিকদের আন্দোলন কোনাবাড়িতে বেশি। আশুলিয়াতে কিছুটা আছে। তবে চট্টগ্রাম এলাকায় আন্দোলন নেই। শিল্প পুলিশ, গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ, র‌্যাব, জেলা পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবাই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। ঘটনায় জড়িতদের ধরতে অভিযান চলছে। সরকার এরই মধ্যে মজুরি ঘোষণা করেছে। আমাদের ধারণা এর পেছনে একটা গ্রুপ এদেরকে উসকানি দিচ্ছে আন্দোলন করার জন্য। এখানে যারা উসকানি দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’ শিল্প পুলিশ সূত্র জানায়, গাজীপুরে ২ হাজার ২৩১টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য ৮টি শনিবারের জন্য বন্ধ থাকে। এ ছাড়া কোনাবাড়ি বিসিকের মধ্যেও কয়েকটি কারখানা বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গাজীপুর ও সাভার শিল্পাঞ্চলে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে শ্রমিকরা। বিক্ষোভের মধ্যে গাড়ি ও কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেধেছে। এই অবস্থার মধ্যে জানমালের নিরাপত্তা ও নাশকতা এড়াতে বেশ কিছু কারখানা তাৎক্ষণিক ছুটিও ঘোষণা করে। গত ৭ নভেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে শ্রমিক নেতারা ঘোষিত মজুরি প্রত্যাখ্যান করেন।

সর্বশেষ খবর