বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি

মনোনয়নপত্র জমা ৩০ নভেম্বর, বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর, প্রত্যাহার ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর

গোলাম রাব্বানী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি

তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ আগামী ৭ জানুয়ারি রবিবার। তফসিল অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ হবে ১৮ ডিসেম্বর। এবারে ভোট দেবে ১১ কোটি ৯৭ লাখ ভোটার। কেন্দ্রসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। ভোটক্ষক ২ লাখ ৬২ হাজার। ৩০০ আসনেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে।

গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। প্রায় ১৪ মিনিটের ভাষণে শুরুতে সিইসি বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ভাষণে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসে সমাধান খোঁজার তাগিদ দিয়ে সিইসি বলেন, আমি সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণ করুন। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।

সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি চূড়ান্ত করতে গতকাল বিকাল ৫টায় নির্বাচন ভবনে সিইসির কক্ষে নির্বাচন কমিশনের ২৬তম সভা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে এ সভায় চার নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান এবং ইসি সচিব জাহাংগীর আলম উপস্থিত ছিলেন। সভায় মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়, বাছাই, প্রত্যাহারের শেষ সময় ও ভোটের দিন ঠিক করে বিস্তারিত তফসিল চূড়ান্ত করা হয়। এর পরই সন্ধ্যা ৭টায় সিইসি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। সিইসির ভাষণ বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এবারে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হবে। সে ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে এবং প্রচারের জন্য ১৯ দিন সময় রয়েছে। ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ করতে হয়। অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটের প্রচার চালানোর সুযোগ থাকবে।

একাদশ সংসদের যাত্রা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুসারেই তফসিল ঘোষণা করছে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’

রাজনৈতিক মতভেদ থাকার কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাক্সিক্ষত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন। আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত ও সহিংতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে।

নিজেরা চেষ্টা করেও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে আনতে না পারার কথাও ভাষণে স্মরণ করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘আগ্রহী সব রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবীসমাজ, শিক্ষাবিদ, নাগরিকসমাজ, সিনিয়র সাংবাদিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে একাধিকবার সংলাপ ও মতবিনিময় করেছি। তাদের মতামত শুনেছি। সুপারিশ জেনেছি। আমাদের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছি। নিবন্ধিত অনাগ্রহী সব রাজনৈতিক দলকেও একাধিকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি মনে করিয়ে দেন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক ?আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।

জনগণকে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, জনগণকে অনুরোধ করব, সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে কেন্দ্রে এসে অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। তিনি বলেন, ‘ভোট আপনার। ভোট প্রদানে কারও হস্তক্ষেপ বা প্ররোচনায় প্রভাবিত হবেন না। কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা বাধার সম্মুখীন হলে একক বা সামষ্টিকভাবে তা প্রতিহত করবেন।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও ফলপ্রসূ করতে সবার সহযোগিতা চেয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাদের বিশ্বাস স্ব স্ব অবস্থান থেকে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল আচরণ ও আবশ্যক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে। দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রশংসিত ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। দেশের জনশাসনে জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে।

সিইসি আরও বলেন, সরকার আসন্ন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বারবার ব্যক্ত করেছে। কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে আবশ্যক সব সহায়তা নিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।

সিইসি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে কেবল সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সংহত ও টেকসই হয়। প্রার্থীরা সে বিষয়ে প্রচারের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে থাকবেন। কমিশনও সর্বসাধারণ ও বিশেষত ভোটারদের উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতে প্রচারমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।

অনিয়ম ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে : সিইসি বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন করতে হবে। নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাকেও আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুধাবন, প্রতিপালন ও প্রয়োগ করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে কোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করতে হবে।

সাহসী পোলিং এজেন্ট নিয়োগের পরামর্শ : সিইসি বলেন, নির্বাচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে প্রার্থী হিসেবে আপনাদের নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা কার্যত আপনাদেরই করতে হবে।

অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল : সিইসি বলেন, আইন-বিধি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনপ্রক্রিয়া সার্বিকভাবে স্বচ্ছ, সহজ, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল করার অভিপ্রায়ে যে কোনো স্থান থেকে অনলাইনে নমিনেশন পেপার দাখিলের এবং স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভোটারসাধারণ ও সর্বসাধারণের জন্য দিনব্যাপী কেন্দ্র ও কেন্দ্রের পোলিং সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের সুবিধাসংবলিত দুটি ডিজিটাল অ্যাপস কমিশন সম্প্রতি চালু করেছে।

আচরণবিধি মেনে চলুন : ভাষণে সিইসি আচরণবিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন করতে হবে। নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাকেও আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুধাবন, প্রতিপালন ও প্রয়োগ করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনবিষয়ক আইন ও বিধিবিধান তাদের অবহিত করার লক্ষ্যে কমিশন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে এবং করে যাচ্ছে।’

জেলা প্রশাসকই রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী ইউএনও : সংসদ নির্বাচনে সব জেলা প্রশাসককে রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সিইসির তফসিল ঘোষণার পর এমন তথ্য জানান ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। তিনি বলেন, ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার থাকবেন। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য বিভাগীয় কমিশনার এবং এ ছাড়া ৬৪ জেলার জন্য ৬৪ জন জেলা প্রশাসক রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। ইসি সচিব বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ৪৯৫ জন, থানা নির্বাচন অফিসার ৫৬ জন, উপপরিচালক স্থানীয় সরকার (ডিডিএলজি) ১৪ জন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আটজন, জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার সিটি করপারেশন ১১ জন, ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার পাঁচজন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) দুজন এবং সার্কেল অফিসার উন্নয়ন একজন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা নির্বাচন অফিসাররা নির্বাচনের সহায়ক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সর্বশেষ খবর