শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাড়ছে ভয়াবহ চার রোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাড়ছে ভয়াবহ চার রোগ

পঞ্চগড়ে চা শ্রমিকের কাজ করতেন আলিফ হোসেন (২৩)। কাজ থেকে ফিরে হঠাৎ অচেতন হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে যান। স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলেও শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আলিফ হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া রহমান বলেন, ‘প্রথমে ডাক্তাররা বুঝতে পারছিলেন না আলিফের কী হয়েছে। ডান হাত অবশ হয়ে যাওয়া দেখে স্ট্রোক সন্দেহ করে দ্রুত ঢাকা নিয়ে আসতে বলেন তারা। আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। স্ট্রোক হওয়ার পর হাসপাতালে আনতে দেরি হওয়ায় বিপদ বেড়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এত অল্প বয়সে স্ট্রোক হয়, এটা শুনে অবাক হয়েছি।’ স্ট্রোকের মতো ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে।

এর মধ্যে বড় একটি অংশ তরুণ। অসংক্রামক এসব দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ। ‘ডিজিজ-স্পেসিফিক ডিসট্রেস হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড ক্যাটাস্ট্রোফিক আউট-অব-পকেট এক্সপেন্ডিচার ফর হসপিটালাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৬ শতাংশ পরিবার গত কয়েক বছরে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) করেছে। এ ধরনের ব্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ক্যান্সার (৫০ শতাংশ), এর পরই রয়েছে যকৃতের রোগ (৪৯.২ শতাংশ) ও পক্ষাঘাত (৪৩.৬ শতাংশ)। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক শুধু বয়স্কদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। ৪০ বছরের নিচে স্ট্রোক রোগী শতকরা ১০ ভাগ। একই সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে ৪০ বছরের নিচে। স্ট্রোক দুই ধরনের হয়- রক্ত জমাট বেঁধে ও রক্তনালি ফেটে গিয়ে।’

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক সিয়াম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে হৃদরোগী বাড়ছে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, ৪০ বছরের নিচে বয়সীদের আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেড়েছে। গত সপ্তাহে আমার পরিচিত একজন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তার বয়স ৩৫। সম্প্রতি আমি এক রোগীর বাইপাস সার্জারি করেছি, তার বয়স ৩০। আগে আমরা বলতাম ৪০ বছর পার হলে হৃদরোগ বিষয়ে সচেতন হতে, পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে। কিন্তু এখন ৩০ বছর পার হলেই হৃদরোগ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ কারণ হিসেবে এই চিকিৎসক বলেন, ‘মানুষ কায়িক পরিশ্রম একদম কমিয়ে দিয়েছে। আগে মানুষ মাঠে খেলাধুলা করত কিন্তু এখন মেদ, স্থূলতা নিয়ে ভুগছে। উৎসব, আনন্দে ঘরের তৈরি খাবারের চেয়ে অনলাইনে জাঙ্কফুড অর্ডার করছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত ও ধূমপায়ীরাও হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন। তা ছাড়া পারিবারিক রোগের ইতিহাস থাকলে বংশগত কারণে অনেকে আক্রান্ত হন। সচেতন হলে হৃদরোগ ঝুঁকি অনেকটা কমানো যাবে।’ দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুরারোগ্য ব্যাধি কিডনি ও ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছে। প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারে। খাদ্যাভ্যাস, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, অতিরিক্ত ওষুধ সেবনকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনে থাকা মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় ধরনভেদে অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি দিয়ে শুধু চিকিৎসা খরচ প্রায় ২-৩ লাখ টাকা পড়ে যায়। এর সঙ্গে যাতায়াত, ওষুধপত্রসহ আনুষঙ্গিক আরও খরচ হয়। বেসরকারি মাঝারি মানের হাসপাতালে এ খরচ প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার আওতায় আসতে পারে মাত্র ৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগী। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারি হাসপাতালে যায়। দেশে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের চিকিৎসার অবস্থা করুণ।’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে কর্মরত আছেন তাইফুল ইসলাম (৩৫)। তার স্ত্রীর দুটি কিডনি দুই বছর ধরে বিকল। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। মাসে কিডনি ডায়ালাইসিসে খরচ ৬ হাজার ৭২০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ, চিকিৎসক, যাতায়াত মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। স্বল্প বেতনে চালাতে না পেরে এর মধ্যেই দেনায় জড়িয়ে গেছি। বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ দ্বিগুণের বেশি। কত দিন চালাতে পারব জানি না।’ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্ট হলে চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে নিয়ে আসতে-যেতে আরেকজনকে সঙ্গে থাকতে হয়। রোগী নিজেও কর্মক্ষম থাকে না, আবার পরিবারের আরেকজন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে তার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাদের কাছে অনেক রোগী শুরুতে কেবিন নিয়ে চিকিৎসা করেন কিন্তু একটা সময় তারা খরচ চালাতে না পেরে বিনামূল্যের শয্যা চান। আমরা ভর্তুকি দিয়ে হলেও রোগী না পারলে তাকে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। কিন্তু একে তো সারা দেশের চিত্র বলা যায় না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর