শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাগাভাগি ভোট ও জোটের হিসাব

আওয়ামী লীগের জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জেপি, কল্যাণ পার্টি, সাম্যবাদী, তরিকতসহ এক ডজন দল, গুঞ্জন তৃণমূল বিএনপিকে নিয়েও ♦ ৫০ আসনের নিশ্চয়তা চায় জাতীয় পার্টি

রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর। আওয়ামী লীগে এখন চলছে জোট ও ভোটের হিসাবনিকাশ। ১৪ দলের শরিকরা ইতোমধ্যে নৌকা চেয়ে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। তৃণমূল বিএনপিও চায় নৌকায় উঠতে। ইসলামী ঐক্যজোটও ভোট করতে চায় নৌকা প্রতীকে। আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ৭০টি আসনের নিশ্চয়তা চায় জাতীয় পার্টি। কার্যত ভিতরে ভিতরে চলছে ভাগাভাগির ভোট ও জোটের হিসাব।

ইতোমধ্যে দলগতভাবে প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। গতকাল রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি। মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে বোর্ডের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বর্তমান সংসদে থাকা অনেক সদস্য বাদ পড়েছেন। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দলের মনোনয়নে চমক রয়েছে। তবে কতসংখ্যক সংসদ সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে মুখ খোলেননি ওবায়দুল কাদের। দলীয় সূত্রমতে, ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী ঠিক করতে আগামী রবিবার পর্যন্ত এ বৈঠক চলবে। সবকিছু ঠিক থাকলে সোমবার চূড়ান্ত তালিকা তালিকা প্রকাশ করা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আগে নিজ দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করছে। দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর জোটসঙ্গীদের নিয়ে বৈঠক করে জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।’

নৌকা নিয়ে ভোট করতে চায় ইসলামী ঐক্যজোট : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা নিয়ে ভোট করতে চায় ইসলামী ঐক্যজোট। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সে অবস্থান আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য আমরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে অংশ নেব। মিছবাহুর রহমান বলেন, আমাদের দল নির্বাচন কমিশনে এখনো নিবন্ধিত নয়। এ কারণে আমাদের দলীয় প্রতীক নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের দল মহাজোটের অন্যতম অংশীদার ছিল। এর আগে আমাদের দল কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তবে আওয়ামী লীগ এবং তার দলীয় প্রধানের দুর্দিনে আমরা পাশে ছিলাম, এখনো থাকব। তিনি বলেন, এবার আমরা ৪০-৪৫টি আসন থেকে নির্বাচন করব।

এদিকে জল্পনা-কল্পনা চলছে নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপিকে নিয়ে। তারাও নৌকায় উঠতে চান বলে গুঞ্জন রয়েছে।

নৌকায় উঠতে চান জোটসঙ্গীরা : আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীরা নৌকা নিয়ে এবারও নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে চান। নির্বাচন কমিশনকে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করার কথাও জানিয়েছে নিবন্ধিত দলগুলো। একইভাবে এ চিঠি আওয়ামী লীগকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, তরিকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি। ১৪-দলীয় জোটে না থাকলেও গত নির্বাচনে বিকল্পধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনি জোটে ছিল। তারাও নিজ দলের প্রতীকের বাইরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ব্যানারে নৌকা প্রতীকে ভোট করার কথা ইসিকে জানিয়েছে।

অন্যদিকে জোটের শরিকদের মধ্যে অনিবন্ধিত বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) তিন নেতা ও গণ আজাদী লীগের এক নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জোটের সঙ্গে যারা রয়েছেন, তারাও মুখিয়ে আছেন নৌকায় উঠতে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জোটের প্রতীক নৌকা নিয়ে লড়ব। সেজন্য নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগকে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া দলের নিজস্ব প্রতীক নিয়েও প্রার্থী মাঠে থাকবে।’

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জোটের আসন ভাগাভাগি এখনো শুরু হয়নি। এখন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাই করছে। এরপর আমাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে আমরা আসন ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলব।’

তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘বিগত দিনেও নৌকা নিয়ে লড়েছি। এবারও তাই করব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ১৫টি আসন চাইব। আওয়ামী লীগ যে আসনগুলো দেবে, সেগুলোয় এবারও নৌকায় ভোট করব। নিজস্ব প্রতীক নিয়েও কেউ ভোট করলে আপত্তি থাকবে না।’

৫০ আসনের নিশ্চয়তা চায় জাতীয় পার্টি : জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেও মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচনে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এজন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০টি আসন প্রত্যাশা করছে দলটি। এ ৫০ আসনে যাতে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রার্থী না দেয় সেজন্য দেনদরবার অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনেই নিজস্ব লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। কারণ কোনো জোটে যেতে আমরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিইনি। তবে রাজনীতিতে বিভিন্ন কৌশল থাকে। আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাব। জাতীয় পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত তিন মেয়াদের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য বা আসন সমঝোতা করেই ভোটে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি। তবে দেশে-বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কৌশলের অংশ হিসেবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে দলটি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে তাদের জোটসঙ্গীদের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে অন্তত ৭০টি আসনে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার জন্য অনুরোধ রয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের প্রত্যাশিত আসন ছাড়া বেগম রওশন এরশাদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, সৈয়দ আবু হোসেন (বাবলা), কাজী ফিরোজ রশীদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, শেরিফা কাদের, সাদ এরশাদ, গোলাম কিবরিয়া টিপু, মশিউর রহমান রাঙ্গা, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, লিয়াকত হোসেন খোকা, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটেয়ারী, ফখরুল ইমাম, রত্না আমিন হাওলাদারসহ দলটির বর্তমান ২৩ এমপির আসনে প্রাথমিকভাবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী না দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া দেনদরবার শেষে আরও অন্তত ১০-১৫টি আসনও জাতীয় পার্টিকে ছাড়তে পারে ক্ষমতাসীনরা। সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩২ থেকে ৩৫টি আসন ছাড় পেতে পারে। এ ছাড়া আরও ৩০ থেকে ৩৫টি আসন আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি-জেপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও তৃণমূল বিএনপি, নবগঠিত জোট যুক্তফ্রন্ট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপি নেতাদের ছাড় দিতে পারে। জানা গেছে, যারা বিগত দুই মেয়াদে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এমপি হয়ে বিএনপি-জামায়াতের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মাঠে সক্রিয় ছিলেন না, তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে যেসব এমপি বিগত দুই মেয়াদে লাঙল মার্কায় এমপি নির্বাচিত হয়েও বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় রাজপথে সক্রিয় ছিলেন তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ও অন্য জোট শরিকদের যেসব নেতার নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক ভিত মজবুত এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তাদের ব্যাপারেও ইতিবাচক মনোভাব ক্ষমতাসীন দলটির। সম্প্রতি নির্বাাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া কল্যাণ পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে ১১টি আসন চাইবে বলে জানা গেছে। ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের দুজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে বৈঠক করে দলটি এ চাহিদা জানিয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম পছন্দের তিনটি আসনের কথা জানিয়েছেন।

জাপার মনোনয়নপত্র বিক্রি : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৭ জন ফরম সংগ্রহ করেছেন। গতকাল ২২৭টি ফরম বিক্রি হয়। আজও ফরম বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা শুরু হবে।

সর্বশেষ খবর