সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কাঞ্চন ব্রিজে নিয়মবহির্ভূত টোল আদায়

♦ মেয়াদ শেষ তবুও টোল আদায় ♦ ব্যক্তিগত ও সরকারি পরিবহন টোল আওতার বাইরে ♦ স্থানীয়দের মালিকানাধীন পরিবহন থেকে টোল আদায় হয় না ♦ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরিবহন মালিকের চুক্তিতে চলে গাড়ি ♦ জরাজীর্ণ টোলপ্লাজা, নেই ডিজিটাল টোল হার বোর্ড

হাসান ইমন

কাঞ্চন ব্রিজে নিয়মবহির্ভূত টোল আদায়

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কাঞ্চন ব্রিজ নির্মাণ করা হয় ২০০৬ সালের অক্টোবরে। সে সময় উদ্বোধনের পরবর্তী ১০ বছর টোল আদায় করার কথা বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো চলছে টোল আদায়।  মেয়াদ শেষ হলেও টোল আদায় অযৌক্তিক বলছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে তালিকায় থাকা ব্যক্তিগত গাড়ি ও সরকারি পরিবহনে (বাস, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস) টোল আদায় করতে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে রূপগঞ্জ পৌরসভায় মেয়রসহ সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় মালিকানাধীন ও ভাড়ায়চালিত গাড়ির টোল আদায় হয় না। এ ছাড়া জরাজীর্ণ টোলপ্লাজা ও টোলের হার নির্ধারণী ডিজিটাল বোর্ড না থাকায় ইচ্ছামতো টাকা আদায় হচ্ছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের সরাসরি সংযোগস্থাপনের জন্য কাঞ্চন ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেতুটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সময় ১০ বছর টোল আদায় করার কথা বলা হয়েছিল বলে সওজের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ হয়। অথচ এখনো টোল আদায় করছে কর্তৃপক্ষ। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও টাকা আদায়ে মানতে পারছেন না পরিবহন চালকরা। পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও টোল আদায় অযৌক্তিক। একই সঙ্গে দুটি করে চারটি টোল কালেকশন বুথ  থেকে ম্যানুয়ালি টাকা আদায় করায় কয়েক কিলোমিটার যানজট হয় প্রায় প্রতিদিন। এতে এই সড়ক ব্যবহার করা পণ্যবাহী গাড়ি ও বাসযাত্রীদের পড়তে হয় যানজটে। ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে পণ্যবাহী ট্রাকচালক মো. ইবরাহীম মিয়া বলেন, প্রতিদিন এই টোলপ্লাজায় কয়েক ঘণ্টার যানজটে আটকে থাকতে হয়। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে ভোগান্তি আরও বেশি। যেহেতু টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ, তাহলে সরকার এখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেই ভালো হবে। তখন যানজটও থাকবে না। এ বিষয়ে টোলপ্লাজার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী বলেন, ১০ বছরের জন্য টোল বিষয়টা ঠিক আছে। তবে সরকার রাজস্ব খাতের আওতায় নিয়ে এসে টাকা আদায় করছে। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারব না।

এদিকে দেখা যায়, কাঞ্চন ব্রিজটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ধুঁকছে। নেই ডিজিটাল টোল নির্ধারণী বোর্ড। কোন গাড়ির কত টাকা টোল সেই ডিজিটাল বোর্ড দেখা যায়নি। এতে কোথাও লাভবান হচ্ছে মালিক, আবার কোথাও টোল আদায়কারী। ক্ষতি হচ্ছে রাজস্ব খাতের। আবার পরিবহনের টোল হার বোর্ডে দেওয়া অনেক গাড়ি থেকে টাকা আদায় করছে না কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আছে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। একই সঙ্গে অধিকাংশ প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও সরকারি পরিবহন (বাস, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস) টোল আওতার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের গাড়ির টোল নেয় না কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কোনো পরিবহনেরও টোল আদায় হয় না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, স্থানীয় পরিবহন মালিকরা নেতাদের সঙ্গে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে। এর মধ্যে একেক জন নেতার আওতায় রয়েছে কয়েক শ গাড়ি। প্রত্যেক গাড়ির মালিক মাসিক কিস্তিতে টাকা দিয়ে থাকেন। বিনিময়ে নিয়মিত টোল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এসব টাকা নেতারা ভাগভাটোয়ারা করে খেয়ে থাকেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে টোলপ্লাজার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী ও নিরাপত্তারক্ষী বলেন, স্থানীয় পরিবহন থেকে টোল আদায় হয় না। এর মধ্যে আছে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, পিকআপ ও পাওয়ার টিলার। কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্মকর্তাদের সমঝোতা হয়েছে। তাদের দেওয়া স্টিকার রয়েছে। এই স্টিকার থাকায় আমরা টাকা আদায় করি না। তবে অনেকে আবার নেতাদের দাপট দেখিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যান। তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে গেলে মারধরসহ হুমকির শিকার হতে হয়। সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। জেনে জানাতে পারব। পরে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নারায়ণগঞ্জ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, কাঞ্চন ব্রিজ থেকে টোল আদায় ১০ বছর হবে এমন কোনো চুক্তি হয়নি। এটা সরকারের রাজস্ব বিভাগের একটা খাত। সরকার চাইলে বন্ধ করতে পারে, আবার চালুও রাখতে পারে। তবে এই ব্রিজ গত বছরে ঢাকা বাইপাস সড়ক পিপিপি প্রজেক্টের আওতায় চলে গেছে। এর সার্বিক বিষয়ে এখন তারা বলতে পারবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বাইপাস সড়কের প্রজেক্ট ম্যানেজার মৌসুমি আক্তার বলেন, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সড়কের আওতাধীন ছিল। এরপর বাইপাস সড়কের আওতাধীন পিপিপি প্রজেক্টের আওতায় চলে আসে। এখন তাদের আওতাধীন ইউডিসি জেবি প্রতিষ্ঠান টোল আদায় করে রাজস্ব খাতে টাকা জমা দিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টোল সব পরিবহন থেকেই আদায় করার নিয়ম। কিন্তু স্থানীয় পরিবহন থেকে টোল আদায় হচ্ছে না এমন অভিযোগ আগে পাইনি। তদন্ত করে দেখব। ডিজিটাল টোল হার বোর্ড প্রসঙ্গে মৌসুমি আক্তার বলেন, কিছুদিন আগেও ডিজিটাল টোল হার দেখিছি। এখন নেই কেন জানি না।

সর্বশেষ খবর