বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চাঁদাবাজদের নৈরাজ্যে অসহায় রূপগঞ্জবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাঁদাবাজির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। চাঁদা না দিলে ঘোরে না যানবাহনের চাকা। খোলে না দোকানের শাটার। প্রতিবাদ করলে জোটে শারীরিক নির্যাতন, ছাড়তে হয় এলাকা। অটোরিকশাচালক থেকে ট্রাকচালক, ফুটপাতের চায়ের দোকানদার থেকে শিল্পকারখানার মালিক সবাইকেই গুনতে হয় দৈনিক বা মাসিক চাঁদা। সরেজমিন গিয়ে সড়কে, বাসস্ট্যান্ডে এমন চাঁদা তোলার অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ ও অনুসন্ধান বলছে, স্থানীয় প্রভাবশালী এমপির ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ওই জনপ্রতিনিধির পিএস-এপিএসরা।

তাদের ছত্রছায়ায় কাজ করেন ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ডধারী কিছু বর্তমান ও সাবেক নেতা। সেই নেতারা আবার চাঁদা তুলতে দৈনিক মজুরিতে নিয়োগ দিয়েছেন শতাধিক সহকারী। যানবাহন ও ছোটবড় দোকান থেকে সহকারীরা চাঁদা তোলেন দৈনিক। ছোটবড় কারখানাগুলোয় প্রতি মাসে টাকার অঙ্ক বুঝে নিতে হাজির হন মধ্যমসারির নেতারা। এ নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দেওয়ারও সাহস করেন না ভুক্তভোগীরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জের চাঁদাবাজির অন্যতম সুবর্ণভূমি ভুলতা-গাউছিয়া। ছোটবড় দোকান, মার্কেট, পরিবহন, কলকারখানা আর মাদক থেকে মাসে চাঁদা ওঠে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ভুলতা বাসস্ট্যান্ড, গোলাকান্দাইল স্ট্যান্ডের প্রায় ৫ হাজার পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় হয় দৈনিক প্রায় ৮ লাখ টাকা। মাসে দাঁড়ায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির পিএসের অধীনে থেকে পরিবহনে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রূপগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ সভাপতি কামরুল হাসান তুহিন। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চাঁদা তুলতে নিয়োগ দিয়েছেন ৪০-৪৫ জন সহকারী। প্রতিটি যানবাহন থেকে দৈনিক তোলা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। টাকা না দিলে ট্রাক চালানোর কথা চিন্তা করার সুযোগ নেই রাজধানীর উপকণ্ঠের এই শহরে। চাঁদা তুলে ছাপানো স্লিপও দেওয়া হচ্ছে যানবাহনের চালকদের। প্রতি মাসে বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে তোলা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা।

ফুটপাত ও মার্কেটের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আলাদা দফতর। ভুলতা-গাউছিয়ায় চাঁদাবাজির আওতায় আছে অন্তত ২০টি মার্কেট। প্রতিদিন চাঁদা ওঠে ২০-২২ লাখ টাকা। মাসে ৬ কোটি ৬০ লাখ। এ খাতটা দেখভাল করেন রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল শিকদার। তার অধীনে দৈনিক মজুরিতে চাঁদা তোলেন ৪০-৫০ জন। চনপাড়ার মাদক সাম্রাজ্যও পরিচালনা করেন ওই জনপ্রতিনিধির পিএস-এপিএসরা। হাত বাড়ালেই মেলে ইয়াবা, আইস, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক। এ খাত থেকেও বিপুল পরিমাণ আয় আসে বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী ওই এমপির এপিএস সংখ্যা প্রায় এক ডজন। তাদের মধ্যে এমদাদুল হক দাদুকে বলা হয় রূপগঞ্জ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তার অধীনে আছে রূপগঞ্জের কলকারখানা, ফুটপাত, মার্কেট, পরিবহন ও রাজনৈতিক পদবাণিজ্য। আরেকজনের নাম মনিরুজ্জামান নাফিস। তিনি প্রভাবশালী এমপির পিএস। অভিযোগ আছে, তিনি স্থানীয় ছাত্রলীগের অভিভাবকের দায়িত্বে আছেন। তিনিও ফ্যাক্টরি ও গার্মেন্ট খাতে চাঁদাবাজির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া আছেন মোহাম্মদ ফিরোজ খান ওরফে বাবুর্চি ফিরোজ, মজিবুর রহমান, হাসিবুর রহমান হাসিব, মুন্না খানসহ অনেকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবাদ করলেই হতে হয় এলাকাছাড়া। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও ঘটে। ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাড়ি আটকে রাখা হয়। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সাহস করে না কেউ। বাধ্য হয়েই দিতে হয় চাঁদা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিএনজিচালক বলেন, ভুলতা-গাউছিয়া স্ট্যান্ডে শাহিন, তুহিন, ফয়সাল এদের লোকজন এসে আমাদের থেকে চাঁদা নেয়। না দিলে গাড়ি চালাতে পারি না। মারধর করে। প্রতিটি দোকানের জন্য রয়েছে চাঁদার আলাদা রেটকার্ড। কাজের সুবিধার্থে ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন জোনে। ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালাতে গেলেও দিনে ১৫০ টাকা দিতে হয়। এদের কাছে অসহায় রূপগঞ্জবাসী।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘আমাদের এখানে কেউ অভিযোগ করেনি, পুলিশ স্টেশনেও করেনি। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর