রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংকটের সুযোগ নেয় বড় প্লেয়াররা

ব্যাংক খাতকে সংকটে নিয়েছে খেলাপি ঋণ - বিআইডিএস সম্মেলন সমাপনীতে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর বার্ষিক সম্মেলনের শেষ দিকে গতকাল বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তরা অভিমত দেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাবে। বিশেষ করে এক্সচেঞ্জ রেটটাকে ঠিক করতে হবে। ডলার সংকট দূর করতে হবে। রপ্তানি আয় ও রিজার্ভ বাড়াতে হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়াতে হবে। রাজনীতিতে একটা সুশাসন আনতে হবে। সবার আগে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিটা কোনদিকে, সেটাকে ঠিক করতে হবে। তারা বলেন, বাজারে সংকট তৈরি হলে বড় প্লেয়ার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে কাজ করার রয়েছে। বক্তাদের মতে, পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখার জন্য সবার আগে ডিমান্ড ও সাপ্লাই চেইনটাকে স্বাভাবিক রাখতে হবে।

গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সামপনী দিনের এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী  ড. এম শামসুল আলম, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আবদুর রউফ তালুকদার। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। ড. এম শামসুল আলম বলেন, স্মাগলিং হলেও সেই টাকাটা কিন্তু এক সময় ফিরেই আসে। সে হোক না স্মাগলিং। মূল্যস্ফীতি আমাদের কমবে। আর সিন্ডেকেটশন নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার। এখানে সিন্ডিকেটের অভিযোগ উঠলেই গুদামে গিয়ে হানা দিই। এটা নিয়েও ভাবা দরকার। কৃষিও তো বেসরকরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমরা সিন্ডিকেটকে দোষ দিতে পারি না। দাম বেড়ে গেলে বা সংকট তৈরি হলেই গুদামে হানা দিই। আমার মনে হয় এটা ঠিক নয়। এটা তো ঘোষণা দেওয়া ব্যবসা। তাহলে কেন গুদামে হানা দেব। এখানে তো সাপ্লাই ও ডিমান্ডকে আগে ঠিক করতে হবে। আমরা তো জানি সামনে ডিমান্ড বাড়বে। তাহলে সময় থাকতেই সাপ্লাই বাড়ালেই তো হয়। তিনি বলেন, ডিমের সংকটের পেছনে কোনো সিন্ডিকেশন ছিল না। এখানে দাম বেড়েছিল সাপ্লাই কমার কারণে। আমদানি হয়েছে, সাপ্লাই বেড়েছে। এখন তো ডিমের বাজার একেবারেই স্বাভাবিক। এখানে আমরা প্রয়োজনে সিন্ডিকেশন সিন্ডিকেশন বলে চিৎকার করি। তবে সিন্ডিকেশন যে হয় না তা আমি বলব না। কিন্তু সেটা খুব ছোট আকারে। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আমরা ভারত থেকে পিঁয়াজ পাওয়ার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাও করছি। আমরা ভারত থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করি। আমরা এখন একটা বাজার অর্থনীতির মধ্যে আছি। এটাকে প্রোপার রান করাতে হলে এখানে অনেক থিওরি রয়েছে। অনেক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ রয়েছে। তখন এখানে যারা বড় প্লেয়ার তারা কিন্তু সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা যখন ডিম, মাংস, মাছ, শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনে স্বযংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ার কারণে এবার আলুর দামটা বেড়ে গেছে। আমাদের ডিমও আমদানি করতে হয়েছে। পিঁয়াজ ৭ লাখ টন আমদানি করতে হয়। শাকসবজি ছাড়া অন্য অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। ৭০ লাখ টন গম, ২২ লাখ টন চিনি, ২৮ লাখ টন সয়াবিন ও অন্যান্য তেল আমদানি করতে হয়। এতে আমাদের খরচও বেশি হয়। দাম নিম্নমুখী রাখতে নানা ধরনের পলিসি নিয়ে সরবরাহ ও সাপ্লাই স্বাভাবিক রাখা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে তেল, চিনির দাম যতটা বেড়েছিল এখন কিন্তু সেটা নেই। অনেকটাই কমে এসেছে। এখানে আমাদের তথ্যেরও ঘাটতি রয়েছে। সেটার কারণেও আমাদের সংকট তৈরি হয়। এই মুহূর্তে রপ্তানিতে আমরা নেতিবাচক ধারায় রয়েছি। তবে অর্থবছর শেষে এটা ইতিবাচক থাকবে বলে তিনি মনে করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জায়েদী সাত্তার বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু ফলাফল তো সে রকম কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। এটা দ্রুত করতে হবে। এর জন্য সবার আগে পলিসি ঠিক করতে হবে। তিনি একই সঙ্গে এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক করা এবং রপ্তানি বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, যারা কর দেন তাদের ওপর অনেক চাপ দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কীভাবে কমানো হবে। এটার জন্য পলিসি কী? এটার জন্য উপায় কী? সমাধান কী হতে পারে। এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা নিয়ে যথেষ্ট কাজ করতে পারছে না। নির্বাচনের পর যে সংস্কারের কথা এসেছে। কিন্তু কী সংস্কার হবে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, এখানে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, খেলাপি ঋণ কেন বাড়ছে। এটাকে কেন সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এর সমাধান কোথায়। কেন কোনো সমাধান আর দেখতে পাচ্ছি না। খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের ঘাটতি ব্যাংক খাতকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। সাবেক সচিব মাহবুবউল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা এখন যেখানে দাঁড়িয়েছে, জোর গলায় দাবি করে বলতে পারছি না যে, আমরা ভালো চলছি। এর প্রতিকার প্রশ্নে আমাদের জাতীয় ঐকমত্য দরকার। তাহলে সমাধান একটা পাওয়া যেতে পারে। আমাদের ব্যাংকে হিউজ সমস্যা। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে দেওয়া হয় না। এর জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রকে কাজ করতে দিতে হবে। গণতন্ত্রকে কাজ করতে দিলে সব সমস্যাই আমরা সমাধান করতে পারব। রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশে জাতীয় বিভেদ বাড়ছে। আমরা জোর গলায় বলতে পারি না যে, ভারতের মতো জাতিগত বিভেদ বা সমস্যা আমাদের এখানে হবে না। অনুষ্ঠানের সভাপতি বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়েক সেন বলেন, শুনেছি ৯৫ বছর বয়সী নারীকে ব্যাংকের পরিচালক বানানো হয়েছে। এটা তো খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এতে বোঝা যায়, আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থার কেন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ড. মসিউর রহমান বলেন, এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এটার জন্য আমাদের একটা পলিসি ঠিক করা দরকার। আমি বলতে চাচ্ছি পলিসিটা হতে হবে মুদ্রার মান কীভাবে বাড়ানো যায় সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, একটা রেগুলেটরি বডি থাকতে হবে। সেটা আছেও। সেটার অনেক দায়িত্ব আছে। সেটাকে ওন করতে হবে। এখানে এটাই হয়ে যায় সরকারের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এখানে ডিকটেটর হয়ে নয়, ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে আমরা খুব একটা সমস্যা দেখছি না। এখানে কৃষি উৎপাদন বেশ ভালো হবে। শিল্প উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিও গত বছরের চেয়ে ভালোই। এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতোই থাকবে বলে আশা করা যায়। আমাদের মূল সমস্যা হলো এক্সটারনাল সেক্টর। ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরেও সমস্যা। কারেন্ট অ্যাকাউন্টে আমরা কিছু স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। ফলে সামনে আমাদের এক্সচেঞ্জ রেটে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আমরা মানিটারি পলিসিতে কার্যকর পরিবর্তন এনেছি। আমরা আমাদের মানিটারি পলিসি কমিটিটাকে পূর্ণাঙ্গভাবে পরিবর্তন করেছি। আমরা পলিসি ফ্রেমিংয়ে নতুন দিকে যাচ্ছি। আমরা বেসরকারি খাতের ক্রেডিট গ্রোথ সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এতে বাইরে চাহিদা কমবে। একই সঙ্গে মানি সাপ্লাইও কমবে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গভর্নর বলেন, চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমানো, এক্সচেঞ্জ রেট স্টেবল করা এবং রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি করা। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এখানে সবার পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। আগামী মুদ্রানীতিতে সেগুলো প্রতিফলিত হবে। আমরা ইচ্ছাকৃত খেলাপি কমানোর চেষ্টা করছি। এটা চিহ্নিত করার পথ বের করা হয়েছে। এতে রাজনীতিবিদরা তেমন কোনো বিরোধিতা করেননি। একই পরিবারের চারজন পরিচালক ছিল, সেটাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিতে পারে কি না, এমডি বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারে কি না, সেখানেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করছে। ফলে এখানে পলিটিক্যাল উইলের যে প্রশ্ন এসেছে, সেখানে তেমন কোনো সমস্যা নেই। বরং এটাতে বেশ ইতিবাচকতাই দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলা হয়েছে। খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এখানে যে কালচারাল ইস্যু। তা খুবই বাজে। আরও কিছু শক্ত মেজার্স নিতে হবে। খেলাপি ঋণ কমানোর যে  উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রতিফলন ঘটবে খুব তাড়াতাড়িই। সংসদীয় আইন আমাকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে আমি তার বাস্তবায়ন করতে পারছি কি না- সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যায় কিন্তু যে ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়নি, সেটা নিয়ে তো কোনো কথা বলা যায় না। তবে আমার (বাংলাদেশ ব্যাংক) অটোনমি আছে কি না, সেটার বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। তবে আমি বলব আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাংক যথেষ্ট স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। এ জন্য আমরা নয়/ছয়-এর যে এমবারগো ছিল সেটা তুলে দিয়েছি। এখন ব্যাংকগুলো হায়ার রেট দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। আবার ঋণের সুদ হার সাড়ে ১১-এর মতো। এদিকে নতুন টাকা ছাপানোও বন্ধ করা হয়েছে। টাকার মানও বাড়তে শুরু করেছে। ডিসেম্বর মাসে এটা আরও ভালো করবে। আমরা মূল্যস্ফীতির চাপও ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারব আগামী জুনের মধ্যে।

সমাপনী অনুষ্ঠানের আগের সেশনে আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমেদ মুশফিক মোবরাক।

সর্বশেষ খবর