বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মিলছে না আসনের সমীকরণ

জাতীয় পার্টিকে নিয়ে দ্বিধায় ক্ষমতাসীনরা ♦ নৌকার প্রার্থী থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় কঠিন, বর্জনের ভাবনা জাপায় ♦ নৌকা পেলেও স্বতন্ত্রকে ঝুঁকি ভাবছে শরিকরা

রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

মিলছে না আসনের সমীকরণ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জোট-মহাজোটের শরিক দলের মধ্যে মিলছে না আসনের হিসাবনিকাশ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক এবং বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আসন নিয়ে আছে টেনশনে। জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকবে কি না দ্বিধায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

‘আমরা সরকার গঠনে প্রস্তুত’ এমন কথা বললেও আওয়ামী লীগের আনুকূল্য চায় জাতীয় পার্টি। যেসব আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৫০টি আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার চায় তারা। এজন্য দফায় দফায় চলছে দেনদরবার। আসন ছাড়ের সমঝোতা না হলে দলটি ভোট বর্জন করতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে আওয়ামী লীগে।

অন্যদিকে নিজস্ব প্রতীক ছেড়ে গত তিনটি নির্বাচনে নৌকায় চড়ে সংসদে আসা ১৪ দলের অনেক শরিক নেতা এবারও নৌকা পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের সংশয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের নিয়ে। জোটের শরিকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে থাকলে তারা বিজয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন। সে কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায় জোট শরিকরা। আওয়ামী লীগ এতে রাজি নয়। অন্যদিকে আসন ছাড় নিয়ে এখনো নিশ্চয়তা পায়নি জোটের কোনো শরিক। ফলে আসন নিয়ে কারোই হিসাব মিলছে না।

গতকাল ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জোট নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জোট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা, গুজব আছে। আমরা সতর্ক আছি। গুজব, গুঞ্জন, সন্ত্রাস-সহিংসতা আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমরা বিচলিত হব না, আমরা জেনেশুনেই নির্বাচনে।’ জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের তারা বলেছে, তারা নির্বাচনে আছে; জোটে থাকতে চায়। তারা তো সরে যাবে বলেনি। সরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। তবে এটা নিয়ে আমরা আরও নিশ্চিত হতে চাই। ১৭-১৮ তারিখ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। অস্থিরতার কিছু নেই।’  জানা গেছে, ‘আসন সমঝোতা’র জন্য হাতে আছে আর মাত্র দুই দিন। দফায় দফায় বৈঠক করেও জোট-মহাজোটের আসন সমঝোতার অঙ্ক এখনো মেলাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ১৪-দলীয় জোটের শরিকরা চান সমঝোতার আসনগুলোতে বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে। তবে এতে মোটেও রাজি নয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সমঝোতার আসনগুলোতে নৌকার প্রার্থী না রাখার ব্যাপারে সম্মতি জানালেও কোনোভাবেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনি মাঠ থেকে সরানো হবে না বলে শরিক ও মিত্রদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে পঞ্চম দফায় বৈঠক শেষে জোট-মহাজোটের আসন সমঝোতা সম্পন্ন হতে পারে, যা ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই জাতির সামনে পরিষ্কার হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে জোট-মহাজোট ও মিত্রদের সবাই এখন তাকিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের দিকে। সমঝোতা হলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নিজ নিজ অবস্থান থেকে একসঙ্গে যৌথভাবে তা প্রকাশ করবে। দল দুটির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। শুধু স্বতন্ত্র প্রার্থীই নয়, আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পার্টির সর্বশেষ ভূমিকা নিয়ে সৃষ্ট অবিশ্বাস ও সন্দেহ। অতীতের মতো এবারও জাপা যাতে দর কষাকষির অজুহাত দেখিয়ে কোনো সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পারে, সেজন্য অত্যন্ত কৌশলী অবস্থান থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। জানা গেছে, জাপাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সন্দেহের কারণ প্রধানত তিনটি। সেগুলো হচ্ছে- আসন নিয়ে অতিমাত্রায় দর-কষাকষি, অরাজনৈতিক ও প্রশ্নবিদ্ধ মহলে দলটির সিনিয়র নেতাদের দৌড়ঝাঁপ এবং দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের রহস্যজনক ভূমিকা ও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রচ্ছন্ন হুমকি। জাতীয় পার্টি ও নির্বাচনি মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে ঝুলে আছে ১৪ দলের জোট শরিকদের আসন চূড়ান্ত করার বিষয়টি। জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী শেষ পর্যন্ত নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন, এটি প্রায় নিশ্চিত। তবে শরিকদের দাবি করা অন্যান্য আসনগুলো নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় তাদের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। তবে আজ বা কালের মধ্যে ১৪ দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের সমঝোতা চূড়ান্ত হতে পারে, এমনটাই আভাস দিয়েছেন সমঝোতার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা।সমঝোতা না হলে ভোট বর্জনের ভাবনা : আসন সমঝোতা না হলে ভোট বর্জনের ভাবনা রয়েছে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। ফের প্রধান বিরোধী দল হতে চাওয়া জাতীয় পার্টি ভোটে থাকতে সম্মানজনক সংখ্যক আসনে জয়ের নিশ্চয়তা চায়।  সূত্র জানিয়েছে, সমঝোতা এবং আসন বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। নৌকা ও ‘আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী’ সরিয়ে ৪১ আসন ছাড়লেই সন্তুষ্ট জাপা। স্বতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হলে তারা চাইছে অন্তত ৬০ আসন। তবে এত আসন ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীনরা। বরং জাপাকে রেখেছে পাল্টা চাপে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের বৈঠক এ চাপেরই অংশ। জাপা সূত্রের মূল্যায়ন, এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে আসন সমঝোতা নিয়ে অসন্তোষ বা অন্য কোনো কারণে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের সরে গেলেও রওশনের নেতৃত্বে দলটিকে নির্বাচনে রাখা হবে। যেভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জন করলে দলের একাংশ রওশনের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিল।  এদিকে তফসিল ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সামনে আসছেন না জি এম কাদের। বনানী কার্যালয়ে তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেন জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে।  দলটির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের কাছে দুই প্রস্তাব রেখেছে জাপা। প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী, জাপাকে যেসব আসন ছাড়া হবে সেখানে নৌকা এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটে থাকবেন না। নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে লড়ে জিতে সংসদে গিয়ে ফের প্রধান বিরোধী দল হবে জাপা। এক্ষেত্রে ৩৫টি আসন ছাড়লেই হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব, ৬০ আসন ছাড়তে হবে। যেখানে নৌকা না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকবেন। তাদের বিরুদ্ধে লড়ে জাতীয় পার্টি অন্তত ৩০ আসন জিতে প্রধান বিরোধী দল হবে। এদিকে ৩০০ আসনে ভোট হলেও ২৮৯ আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কেন ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে শেরপুর জেলা জাতীয় পার্টির নেতা মো. রফিকুল ইসলাম বেলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করে আসছি। বর্তমানে শেরপুর জেলার ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছি। আমি ছাড়া এ আসন থেকে অন্য কেউ মনোনয়ন পর্যন্ত নেয়নি। সাক্ষাৎকারে পার্টির চেয়ারম্যান-মহাসচিব পর্যন্ত ভোট করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য কোনো শক্তির ইশারায় আমাকে দল থেকে মনোনয়নই দেয়নি। তিনি দুঃখ করে বলেন, ৩০০ আসনে ভোট করার ঘোষণা দেওয়ার পর যদি আসন ফাঁকা রাখা হয় তাহলে দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে না।

সর্বশেষ খবর