বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রেললাইন কেটে ভয়ংকর নাশকতা

নিহত ১ আহত ১৩, ইঞ্জিন ও সাত বগি লাইনচ্যুত

নিজস্ব প্রতিবেদক

রেললাইন কেটে ভয়ংকর নাশকতা

গাজীপুরে লাইনচ্যুত ট্রেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা ১১ দফা অবরোধের দ্বিতীয় দিনে গতকাল গাজীপুরে রেললাইন কেটে ভয়ংকর নাশকতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ট্রেনের ইঞ্জিন ও সাত বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় এক যাত্রী নিহত এবং অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ট্রেনচালক ইমদাদুল হক, সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া ও রুপালি সাহাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডি, শাহবাগ এবং পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। গাজীপুর থেকে খায়রুল ইসলাম জানান, গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশন সংলগ্ন বনখড়িয়া এলাকায় দুর্বৃত্তরা জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন কেটে ফেলায় ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ নামের একটি ট্রেনের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে এক ব্যবসায়ী নিহত এবং কমপক্ষে ১৩ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে লোকো মাস্টার মো. এমদাদুল হক, সহকারী লোকো মাস্টার মো. সবুজ মিয়াও রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে গতকাল এ রিপোর্ট পাঠানো পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে ময়মনসিংহগামী ট্রেন ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ হয়ে চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার ভোররাত ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছেন জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মো. হানিফ আলী। দুর্ঘটনায় নিহত মুরগি ব্যবসায়ী আসলাম হোসেন (৩৫) গফরগাঁও থানার রওহা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফীন স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানান, রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতকারীরা গ্যাস কাটার দিয়ে ভাওয়াল স্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকার চিলাই ব্রিজ সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের পূর্ব পাশের প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখে। রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সেখানে আসা মাত্রই বিকট শব্দে ইঞ্জিন ও পরবর্তী সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইনের ঢালে কাত হয়ে পড়ে। এ সময় ইঞ্জিনটি বগি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশের জমিতে কাত হয়ে পড়ে যায়। এ ঘটনায় রেললাইনের অন্তত ৬০০ ফুট দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন এসে ভিড় জমায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেলসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রেললাইনের পাশ থেকে একটি ও ঘটনাস্থলের পাশের জঙ্গল থেকে আরেকটি গ্যাসের সিলিন্ডার (বোতল) উদ্ধার করেছে। প্রতিটি সিলিন্ডার ১২ কেজি ওজনের। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা জানান, ঘন কুয়াশার কারণে ঘটনার সময় ট্রেনের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। যার কারণে ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। গতি বেশি থাকলে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এদিকে সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ সময় শ্রীপুর থেকে একটি ইঞ্জিন এনে দুর্ঘটনা কবলিত বগি বাদে অবশিষ্টগুলো টেনে শ্রীপুর স্টেশনে নিয়ে যায়। বিকাল থেকেই রেললাইন মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন স্টেশনে কয়েকটি ট্রেন আটকে পড়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন এসব ট্রেনে থাকা শত শত যাত্রী।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনের দুই পাড়ে দুটি উদ্ধারকারী ট্রেন কাজ করে। প্রথমে লাইনে থাকা বগিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন সংস্কার করে ট্রেন দুটি কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে। পরে লাইনচ্যুত বগিগুলো লাইনে উঠিয়ে উদ্ধারকারী ট্রেন টেনে নেবে। উদ্ধার অভিযানে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মীরা কাজ করছেন।

আহত ১৩ জন : গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ১৩ জনকে এখানে আনা হয়েছে। তারা হলেন- ট্রেন চালক মো. ইমদাদুল হক (৫৭) ও সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া (৩২), ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রফিকুল মোল্লা (৩৫), একই উপজেলার জামিলা (৩৫), কুমিল্লার জসিম উদ্দিনের মেয়ে সুরভী সাহা (১৮), গৌতম সাহার স্ত্রী রুপালি সাহা (৪০), মনির উদ্দিনের ছেলে বেলাল উদ্দিন (৪০), জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা (৪২), নিজাম উদ্দিনের ছেলে জলিল (৩৮), লালু মিয়ার ছেলে সুমন (২৫), কুদ্দুসের ছেলে সবুজ (৩২), ইসমাইল হোসেনের ছেলে এমদাদ (২৫) ও নেত্রকোনার গনু মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম মোল্লা (৪০)। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ট্রেনচালক ইমদাদুল হক, সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া ও রুপালি সাহাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। অপর আহত রফিকুল ইসলাম মোল্লা, জামিলা ও সুরভী সাহাকে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন। রেল কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেন ভুইয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেনগুলো ভৈরব-কিশোরগঞ্জ হয়ে চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বলাকা কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ও মহুয়া কমিউটার ট্রেনের যাত্রা কর্তৃপক্ষের আবেদনে বাতিল করা হয়েছে। ভয়ংকর নাশকতার ঘটনার পর পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান, ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক, র‌্যাব-১-এর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর ইয়াসির আরাফাত হোসেন, শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা ইয়াসমীন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক জানান, এ ঘটনায় নাশকতার আলামত পাওয়া গেছে। লাইনের একটা অংশ সম্ভবত অক্সি এসিডেটিং গ্যাস জাতীয় কিছু একটা দিয়ে কাটা হয়েছে। যার কারণেই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান জানান, ঘটনাটির সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিনি আরও বলেন, রেললাইনের অন্তত ২০ ফুট অংশ গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। ঘটনাস্থলের কাছেই একটি গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, ১৪ ঘণ্টা শেষে রাত পৌনে ৮টার দিকে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বগি ও মালামাল সরিয়ে নেওয়ার পর ট্রেন চলাচল শুরু করবে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, ‘এটি পুরোই নাকশতামূলক কাজ। যারা এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নাশকতাকারীদের আইনের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড় করানো হবে।’ গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে আমরা এটাকে ‘নাশকতামূলক’ কর্মকান্ড হিসেবে বিবেচনা করছি। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপরদিকে সন্ধ্যায় ঢাকা রেল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, দুর্ঘটনায় শুধু রেললাইনের বগি-ইঞ্জিনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ইঞ্জিন-বগির পাশাপাশি ৬০০ ফুট রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০০টি স্লিপার পুরোই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তিন শ ফুট রেললাইনে নতুন করে পাত বসানো হচ্ছে। শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, রেললাইনে নাশকতার এ ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যারা নাশকতাকারী, যারা এতবড় একটি দুর্ঘটনার পরিকল্পনা করেছে তাদের সবাইকে খুঁজে বের করা হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, নিহতের পরিবারকে রেলওয়ের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এটা পুরোপুরি নাশকতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে রেললাইন গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই লাইনে সর্বশেষ ট্রেন চলেছে ৩টার দিকে। পরে এক ঘণ্টার ব্যবধানে স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।

এদিকে, রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুনের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিউটি অফিসার লিমা খানম বলেন, সোয়া ৯টায় ধানমন্ডি-১৫ নম্বরে রজনীগন্ধা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগার খবর পান তারা। পরে তাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ছাড়া শাহবাগ মোড়ে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে কে বা কারা অগ্নিসংযোগ করে। ওই খবরে দুপুর ২টা ৪২ মিনিটে পলাশী ফায়ার স্টেশনের দুটি ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। বিকাল ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, পুরান ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে সদরঘাট টু আশুলিয়া রুটের সাভার পরিবহন নামের একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রী নিয়ে সাভার পরিবহনের বাসটি কবি নজরুল কলেজের সামনে থামায়। এরপর হঠাৎ দেখি বাসের পিছনে আগুন। আগুন দেওয়া মাত্রই বাসের যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নেমে পড়েন। মুহূর্তেই বাসটির ভিতরের সিট, লাইট, ফ্যানসহ বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় জনগণ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। তাই ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজন পড়েনি বলে জানান পুলিশ সদস্যরা।

সর্বশেষ খবর