রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নে বালু নদ থেকে উদ্ধার করা শিশু ওসমান গণি স্বাধীনকে (৯) খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পরিবারের দাবি, বসতভিটা লিখে না দেওয়ায় একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক রফিকুল ইসলাম ওরফে আন্ডা রফিক এবং তার ভাই মিজানুর রহমান ওরফে কুত্তা মিজানের নির্দেশে স্বাধীনকে খুন করে তাদের ক্যাডার বাহিনী। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন স্বাধীনের পরিবার। এ সময় স্বাধীনের বাবা শাহিনুর রহমান শাহিন, মা উম্মে হানি মুন্নি এবং দাদা রেজাউল আলম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্বাধীন নিখোঁজ হয়। ৪ ডিসেম্বর নৌ-পুলিশের সদস্যরা তার লাশ ইউনিয়নের নাওড়া বাজারের পাশে ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীনের বাবা শাহিনুর রহমান বলেন, আমি শিশু স্বাধীনের হতভাগ্য পিতা। আজ আপনাদের সামনে এসেছি, কারণ আমার অবুঝ সন্তানের মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল না। তাকে নৃশংসভাবে খুন করে লাশ গুম করার উদ্দেশে নদীতে ফেলা হয়। আমাদের সন্তানকে খুন করা হয়েছে একজন প্রভাবশালীর নির্দেশে। অবুঝ সন্তান হত্যার বিচার পেতে আমরা থানায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারিনি। থানা তার নামে মামলা না দিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করার পরামর্শ দেয়। সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমরা সন্তান হত্যার বিচার পাব না। কারণ আমার অবুঝ সন্তানটির হত্যাকারী হলেন আমাদের ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক আন্ডা রফিক ও তার ভাই কুত্তা মিজানের নির্দেশে। তারা এলাকায় এত বেশি প্রভাবশালী যে সন্তানকে কবর দেওয়ার পর আমরা বাড়িতে থাকতে পারি না। বিচার কীভাবে পাব? তাদের বাহিনী আমার সন্তানের হত্যাকান্ড নিয়ে কথা বললে আমাদেরও মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। বাড়িতে পাহারা বসিয়েছে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চেয়ে শাহিন বলেন, আপনারা প্রয়োজনে কায়েতপাড়ার নাওড়া গ্রামে যান। নিজেরা অনুসন্ধান করেন। তাহলে বেরিয়ে আসবে হত্যাকারীদের নাম। দয়া করে আপনারা আমার সন্তান হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করেন। আমি আপনাদের কাছে সন্তানের প্রকৃত খুনিদের বিচার চাই। আমি একা বললে এ হত্যাকান্ডের বিচার কখনোই হবে না। কারণ আন্ডা রফিক ও তার ভাই কুত্তা মিজান কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সর্বত্র ভয়, আতঙ্ক আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আমাদের এলাকায় রফিক-মিজানের শাসনই শেষ কথা। স্বাধীনের বাবা বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যাকান্ডের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার করুন, যাতে করে এসব বর্বর জানোয়ার পাষ- মানুষ নামের পশুগুলো আর কারও অবুঝ সন্তানকে খুন করার সাহস না পান। আর কারও মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। স্বাধীন হত্যাকান্ডে আমাদের করা অভিযোগটি আমরা চাই সিআইডি অথবা পিবিআই তদন্ত করুক। আমাদের বিশ্বাস সিআইডি বা পিবিআই তদন্ত করলে হত্যাকান্ডের আসল রহস্য উদঘাটন হবে ও প্রকৃত অপরাধীরা শনাক্ত হবে। পুলিশ এ হত্যাকান্ড তদন্ত করলে হত্যাকান্ডের প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন হবে না। কারণ এ হত্যাকান্ড নিয়ে আমাদের করা অভিযোগই নিতে পারেনি রূপগঞ্জ থানা পুলিশ।
স্বাধীনের বাবা শাহিনুর আরও জানান, ১ ডিসেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বাধীন নিখোঁজ হলে আত্মীয় স্বজনসহ ২০-৩০ জন মিলে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাইনি। এরপর রাত আটটার দিকে তার সন্ধান চেয়ে মসজিদের মাইকে মাইকিং করতে গেলে মুয়াজ্জিন জানান, রফিকুল ইসলামের নিষেধ আছে। এ বিষয়ে মাইকিং করা যাবে না। এখন তার ক্যাডার বাহিনী সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে আমার সুস্থ-সবল সন্তানটি নাকি প্রতিবন্ধী ছিল। সে পানিতে পড়ে মরে গেছে। আপনারা আমাদের এলাকায় গিয়ে খবর নেন, সে আসলে প্রতিবন্ধী ছিল কি না। সন্তানের লাশ দেখতে দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সন্তানের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়ি নিয়ে আসি। বাড়ি এসে দেখি রফিকুল ইসলামের লোকজন হুজুর নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাড়িতে গাড়ি আসার পর তারা ওসমান গণি স্বাধীনের কাছে আর আমাদের যেতে দেয়নি। আমার সন্তানের লাশটাও শেষবারের মতো কাউকে দেখতে দেয়নি। রফিকুল ইসলামের নির্দেশে পরিবারের অনুমতি না নিয়েই রাতের অন্ধকারে আমার শিশুটির লাশ কবরস্থ করে। স্বাধীনের মা উম্মে হানি বলেন, আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলামকে দিয়ে দিলে আমার শিশু সন্তানটির এমন করুণ পরিণতি হতো না। রফিকুল ইসলামের চাওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ ও আমাদের ৩৫ শতাংশের বসতভিটিটা যে তার খুবই প্রয়োজন ছিল তা আমার সন্তানকে মেরে রফিকুল ইসলাম বুঝিয়ে দিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম জায়গার জন্য এমন জঘন্য কাজ করবেন, তা বুঝতে পারলে অনেক আগেই বাড়িটা দিয়ে দিতাম। শিশুটির লাশ যারা দেখেছেন সবাই কেঁদেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে বিচার দিয়েছেন। কারণ তার লাশ যাতে শনাক্ত না করা যায়, পুরো মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীর অ্যাসিড জাতীয় কিছু দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। আমি অবুঝ ওসমান গণি স্বাধীনের ওপর এমন হিংস্র আক্রমণের বিচার চাই। আমাদের সন্তানকে এত বেশি কষ্ট দিয়ে মেরেছে যে, আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এই লাশটি আমাদেরই সন্তানের। পরনের প্যান্ট দেখে আমরা ওসমান গণিকে শনাক্ত করি। লাশ উদ্ধারে অংশ নেওয়া নৌ-পুলিশের সদস্যরাও অনেক আফসোস করে বলেছেন, এমন বীভৎস ও নৃশংসভাবে কাউকে হত্যা করা লাশ এর আগে কখনো তাদের উদ্ধার করতে হয়নি। প্রয়োজনে আপনারা নৌ-পুলিশের এসআই আসাদুজ্জামান সাহেবের কাছে যান। উনি আমার সন্তানের লাশ উদ্ধার করেছেন। উনি বলবেন কতটা নির্মম ছিল এ হত্যাকান্ড। স্বাধীনের দাদা রেজাউল আলম বলেন, রফিকুল ইসলাম দুই মাস আগে আমাদের বাড়ি নামমাত্র দামে কিনতে তার বোনকে পাঠান। তার সঙ্গে আরেকজন মহিলাও ছিল। তারা আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলাম কিনতে চান বলে জানালে বলি, মাগো বাড়ি বিক্রি করলে আমরা থাকব কই। তারপরও যদি কখনো বিক্রি করি আমি নিজেই রফিক সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসব, তোমাদের আর কষ্ট করে আসতে হবে না। তিনি বলেন, এরপর থেকে রফিকুল ইসলাম শুরু করেন ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, চাঁদাবাজি। আমার নাতিকে খুন করার দুই মাস আগে থেকে একাধিকবার বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। দোকানে দুই দফা হামলা করে মারধর করে। পরে আমাদের দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও পরিবার নিয়ে থাকার বাড়িটি বিক্রি করতে রাজি হয়নি। আমার নাতিকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে রফিক-মিজানের ক্যাডার ফারুক বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যায়। আমার ছেলেকে রফিক চিহ্নিত ক্যাডার ফারুক পিস্তল দেখিয়ে বলে এমন মারা মারব, কবরে গিয়েও শান্তি পাবি না। এসব ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পর স্বাধীন নিখোঁজ হয়। এরপর আমরা তার বীভৎস লাশ পাই।