মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সম্পদের বিকাশ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে

ইফতেখারুজ্জামান

সম্পদের বিকাশ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের অর্থ-সম্পদের যে অস্বাভাবিক বিকাশ হয়েছে তা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে হয়েছে। তারা জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী হিসেবে যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এর অপব্যবহার করেই তারা এ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এমনটি ধারণা করার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কারণ বৈধ আয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বা বিশ্বের কোনো দেশেই এ ধরনের অস্বাভাবিক অর্থ আয়ের সুযোগ মানুষের নেই। হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয়েছে এর বাইরে দেশে-বিদেশে আরও সম্পদ আছে কি না তাও যাচাই করা দরকার । ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ নিয়ে হলফনামার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা আপাতদৃষ্টিতে যে কোনো সাধারণ মানুষের কাছে চোখে অবিশ্বাস্য ধরনের সম্পদের বিকাশের তথ্য। তবে সবার ক্ষেত্রে এ তথ্য সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। যারা নির্বাচিত হয়ে দায়িত্বশীল অবস্থানে থাকেন তাদের বৈধ পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে আয় বা বেতনভাতা ইত্যাদি তার বাইরেও বৈধ আয়ের সূত্র থাকার কথা। যেমন- কেউ যদি পেশায় চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা ব্যবসায়ী হন তাহলে নিজস্ব ও বৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জিত সম্পদ ও অর্থ তাদের থাকার কথা। এ সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করার উপায় নেই। তবে নিয়ম অনুযায়ী একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর কোনো রাষ্ট্রীয় মুনাফা অর্জন করার মতো রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী হিসেবে নিজেদের বেতনভাতার বাইরে ব্যক্তিগত বৈধ অর্থ উপার্জনের সুুযোগ তাদের থাকতেই পারে। তবে এটি সব জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। সার্বিকভাবে যে চিত্র উঠে আসছে তা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। অনেকটাই অবিশ্বাস্য এবং চরমভাবে একটি উদ্বেগজনক চিত্র। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে যে বিষয়টি উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে, সেটি তার দ্বিগুণ উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। এর কারণ যে তথ্যগুলো প্রকাশিত হচ্ছে তা প্রথমবারের মতো নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে এটি যখন করা হয় আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে, জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব বৈধ প্রক্রিয়ায় উপার্জন হচ্ছে কি না তা জানার সুযোগ করে দেওয়া। জনগণ এটি জানতে পারছে কিন্তু এই উপার্জন সত্যিকার অর্থে বৈধ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কি না তার যথার্থতা যাচাই করার উপায় নেই। জনমনে ধারণা হচ্ছে এই বিপুল সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে। অথচ যাচাই করার জন্য যে কর্র্তৃপক্ষ আছে তাদের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা যে তথ্য হলফনামায় দিয়েছেন তা আসলে বাস্তব কি না বা এর বাইরেও কারও ক্ষেত্রে কিছু আছে কি না সেটিও দেখতে হবে। কারও ক্ষেত্রে হলফনামায় দেওয়া অর্থের বাইরেও আরও সম্পদ থাকতে পারে। এটি অস্বাভাবিক নয়। কারও ক্ষেত্রে দেশের বাইরেও সম্পদ থাকতে পারে। তার কোনো যথার্থ তথ্য আছে কি না এসব যাচাই করতে হবে। আর এটি যদি যাচাই না হয়ে থাকে, বাস্তবতার সঙ্গে যদি অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ হলফনামা তথ্য হয় তাহলে এটি তথ্য গোপন করার দায়ে একটি অপরাধ।

মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবং তা নির্বাচন কমিশনের কাছে এসেছে তা যদি প্রমাণিত হয় যে তাদের অর্জিত সম্পদ বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তবে এটি হবে ফৌজদারি অপরাধ। যা শাস্তিযোগ্য। সম্পদ বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা দেখার দায়িত্ব তিনটি প্রতিষ্ঠানের। নির্বাচন কমিশন যদি প্রত্যক্ষ ও আইনগতভাবে কোনো প্রার্থীর সম্পদ তার বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পায় তাহলে প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি নির্বাচনের পরও যদি এটি প্রমাণিত হয় যে, প্রার্থীর আয় অবৈধ সেক্ষেত্রেও প্রার্থিতা বাতিল হবে। তবে এই কাজটি কখনো নির্বাচন কমিশন করেছে বা করার উদ্যোগ নিয়েছে এর কোনো কার্যকর দৃষ্টান্ত নেই। এ ছাড়া দুদক, তার আইন অনুযায়ী বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে পারে। হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সেখানে প্রত্যেকের এই তথ্যের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে কর রিটার্নের তথ্য আছে। আর কর রিটার্নের তথ্যের সঙ্গে এই তথ্যের যদি অসাঞ্জস্যতা থাকে তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এটি প্রতীয়মান হবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তথ্য গোপন করেছেন এবং কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এমন করেছেন। এক্ষেত্রেও তাদের জবাবদিহিতার বিষয় আছে। কারও ক্ষেত্রে দেশের বাইরে সম্পদের মালিকানা যদি থাকে এবং কীভাবে এই মালিকানা তিনি অর্জন করেছেন সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরে সম্পদ অর্জন করতে হলে যথাযথ প্রক্রিয়া মানতে হবে। আর সেই প্রক্রিয়া মানা হয়েছে কি না সেটি তদন্ত করতে হবে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদি সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু, সব দলের অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তির পাশপাশি সততার সঙ্গে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আগ্রহী ব্যক্তি যদি রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুুযোগ থাকত তাহলে জনগণের হাতে বিচার করার সুযোগ থাকত। যারা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের মালিক হয়েছেন তাদের জনগণ প্রত্যাখ্যান করতে পারত। যারা সুস্থ ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং জনস্বার্থে রাজনীতি করেন তাদের পক্ষে জনগণ রায় দিতে পারত। কিন্তু এই সুযোগ জনগণের জন্য নেই।

সর্বশেষ খবর