শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বতন্ত্রে ভয় জাতীয় পার্টির ২৬ প্রার্থীরই

নৌকা ছাড় না পাওয়া প্রার্থীদের ক্ষোভ-হতাশা

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

স্বতন্ত্রে ভয় জাতীয় পার্টির ২৬ প্রার্থীরই

আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ২৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জন্য নৌকা প্রতীক ছাড় দেওয়া হলেও ওইসব আসনে এখন আতঙ্ক ক্ষমতাসীন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নৌকা ছাড় পাওয়া জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, নৌকার প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষেই দলীয় নেতা-কর্মীরা কাজ করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মার্কা যাই হোক তাকেই ভোট দেবেন তারা। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ের জন্য আশাবাদী হতে পারছেন না। এদিকে নৌকা ছাড় না পাওয়া জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ-হতাশা। ২৮৩ আসনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ভোট করা এসব প্রার্থী বলছেন, মনোনয়ন দেওয়া থেকে আসন সমঝোতা পর্যন্ত সব কিছুতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। যারা বারবার এমপি হয়েছেন, তারাই আবার এমপি হবেন। গোপন সমঝোতা করে দলের হাজারো নেতা-কর্মীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এতে জাতীয় পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্বতন্ত্র প্রার্থীতে ভয় : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তারা এবার দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা পাচ্ছেন না। এনিয়ে জাতীয় পার্টিতে অসন্তোষের সীমা নেই। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আসন সংখ্যা কমানোর ব্যাপারে আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উপস্থিতি। স্বতন্ত্র প্রার্থীভীতির কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সমঝোতার ফলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা মাঠে না থাকলেও আওয়ামী লীগের যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী তার পক্ষে নৌকার নেতা-কর্মীরা কাজ করবেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দেবেন।

কাগজে-কলমে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও সারা দেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। বিশেষ করে এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্তি অনেক দুর্বল এবং গত ১৫ বছরে ক্ষমতার সঙ্গে থাকায় জনগণের মাঝে তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। দলটি আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ বা ‘একান্ত অনুগত বিরোধী দল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে সংসদে যাওয়ার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় আওয়ামী লীগের সমর্থন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি আওয়ামী লীগের ভোটগুলো মোটা দাগে নিয়ে যান তবে একটি বড় ধরনের বিপদ তৈরি হতে পারে।

বিভিন্ন নির্বাচনি ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গত উপনির্বাচনগুলোয় জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে যেখানে নির্বাচন করেছে একমাত্র রংপুর সিটি করপোরেশন ছাড়া আর কোথাও তারা ভালো করতে পারেনি। এমনকি সম্মানজনক ভোটও পায়নি অনেক এলাকায়। তাদের তুলনায় হাতপাখা (ইসলামী আন্দোলন) অনেক স্থানে ভালো ফলাফল করেছে। জাতীয় পার্টির নৌকা ছাড় পাওয়া নেতারা আশঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে তাদের বড় ধরনের ভরাডুবি ঘটতে পারে।

নৌকা ছাড় না পাওয়া প্রার্থীদের ক্ষোভ-হতাশা : নৌকা ছাড় না পাওয়া ২৮৩ আসনে ভোট করা জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ-হতাশা। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়নি বললেও ২৬ আসনে ‘গোপন সমঝোতা’ করেছে জাতীয় পার্টি। জানা যায়, গত শুক্রবার রাতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের বৈঠকে সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। আসন সমন্বয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, লিয়াকত হোসেন খোকা, নাসরিন হাওলাদার রত্না, পীর ফজলুর রহমানসহ কিছু নেতাকে বাদ দেওয়া হয়। তারা যে বাদ পড়ছেন তা সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা নেতারা জানা সত্ত্বেও বিষয়টি গোপন রেখে রবিবার মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত ‘নাটক মঞ্চস্থ’ করেন। রবিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে ‘২৮৩ আসনে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করছে’ জানালেও ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সমঝোতার বিষয়টি এড়িয়ে যান দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। সূত্র জানায়, মনোননয়ন প্রত্যাহারের দুই দিন আগেই ২৬ আসনে নৌকা প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করার শর্তে ‘গোপন সমঝোতা’ করে জাতীয় পার্টি। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি প্রকাশ না করার কৌশল নেন যাতে বাকি ২৫৭ আসনের দলীয় প্রার্থীদের বিদ্রোহ-হাঙ্গামা যেন প্রকাশ্যে না আসে। নৌকা ছাড় না পাওয়া প্রার্থীরা বলছেন, জি এম কাদের নিজের, স্ত্রী শেরিফা কাদের, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ বারবার সমঝোতায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলেও দলের ত্যাগী মধ্যমসারির নেতাদের জন্য কিছুই করতে পারেননি। জি এম কাদের ও চুন্নু কখনো কোনো দলের ‘দালালি’ করবেন না বলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু এমপি হওয়ার ‘ব্যক্তি স্বার্থে’ তারা সে কথা রাখেননি। তাই দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী জাতীয় পার্টির সমঝোতাকারী শীর্ষনেতাদের ওপর এখন চরম ক্ষুব্ধ। ‘গোপন সমঝোতায় বাদ পড়া ২৫৭ আসনের প্রার্থী-সমর্থকরা হাঙ্গামা করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অনেকেই নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। শেষ সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, মীর আবদুর সবুর আসুদ, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ অনেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। সমঝোতা না হওয়ায় কেউ কেউ দলীয় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও ক্ষুব্ধ দলটির অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নির্বাচনি মাঠে থাকছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা-৪ আসনে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জামালপুরে মোস্তফা আল মাহমুদ, বর্তমান সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহসহ অনেকে।

জানতে চাইলে আসন সমঝোতার বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, এলাকায় গত ১০ বছর সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। মানুষের সুখে-দুখে ছিলাম। দল-মত নির্বিশেষে কারও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াইনি। এ জন্য লাঙ্গলের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। নির্বাচন করছি। তিনি জানান, গতকাল শ্যামপুর থানার দোলাইপাড় আমির টাওয়ারের সামনে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ হাজারের বেশি কর্মী-সমর্থক নিয়ে প্রচার শুরু করেছি। সুষ্ঠু ভোট হলে বিজয়ী হতে পারব।

শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি মাঠে থাকার কথা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৩ সোনারগাঁও আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে এলাকায় ব্যস্ত আছি। নির্বাচন সুুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে সমঝোতা ছাড়াই ইনশাআল্লাহ জয়ী হব। সমঝোতার আসন থেকে বঞ্চিত দলটির এক প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাচন এলে একটি চক্র সবসময় সুবিধা নেয়। তৃণমূলের মতামত ছাড়া এবার বিশেষ কাউকে সুবিধা দেওয়া হবে না বলা হলেও নেতারা কথা রাখেননি। দলের চেয়ারম্যান নিজের কথার ওপর নিজেই অবিচল থাকতে পারেননি। তার ওপর নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস আর নেই।

সর্বশেষ খবর