শিরোনাম
বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
একসঙ্গে তিন বগিতে আগুন

নাশকতার আগুনে জীবন্ত দগ্ধ ৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

নাশকতার আগুনে জীবন্ত দগ্ধ ৪

স্ত্রী সন্তানকে হারিয়ে আর্তনাদ। আগুনে পুড়ে ছাই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি -জয়ীতা রায়

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চলন্ত ট্রেনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মা-ছেলেসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ভোর ৫টার দিকে নেত্রকোনা থেকে ঢাকার কমলাপুরগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ‘ছ’ ‘জ’, ‘ঝ’- তিনটি বগিতে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে হৃদয়বিদারক এ ঘটনা ঘটে। পরে ‘জ’ বগি থেকে মা, সন্তানসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। নৃশংস এ ঘটনায় নিহতরা হলেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) এবং তার তিন বছরের সন্তান ইয়াসিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে থাকা বাকি দুজন পুরুষ লাশের একজনকে রশিদ ঢালী বলে দাবি করেছেন তার ভাতিজা বেলাল আহমেদ। অন্যদিকে ভয়ংকর এ ঘটনার তদন্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং একাধিক সংস্থার সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তদন্ত শেষে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বৃত্তরা ট্রেনের ভিতর থেকেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনটি বগিতেই একসঙ্গে আগুন দেওয়া হয় বলে তাদের ধারণা।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, গতকাল ভোর ৫টা ৪ মিনিটে তারা আগুনের খবর পায়। তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের তিনটি ইউনিট ৫টা ১২ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।

তেজগাঁও রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ট্রেনের চাকায় আগুন লেগে গেলেও ট্রেনের বাইরে কোনো আগুন লাগেনি। আগুন শুধু বগির ভিতরে ছিল, তাই আমরা সন্দেহ করছি এটি ভিতর থেকেই লেগে থাকতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, এখানে ট্রেনটি থামার কথা ছিল না। তবে আগুন দেখে ‘ডেনজার সিগন্যাল’ দিয়ে ট্রেন থামানো হয়। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। আগুনে ‘ছ, জ, ঝ’ কোচ পুড়ে গেছে। তিনটিই এসি কোচ। পরে ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ঘটনাস্থল তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর উৎসুক মানুষ ভিড় করেছে। সবার চোখেমুখেই উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। তারা কারও জীবনই নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করে। যে-কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছিল। স্টেশনের লাগোয়া বিভিন্ন স্থাপনায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নাশকতার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। পিবিআই পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি যে তিন ব্যক্তি বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনের তিনটি বগিতে উঠেছিলেন, তারা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন। বিমানবন্দর স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ এবং কারা সেখান থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন এবং তেজগাঁও স্টেশনে কারা নেমেছেন তা জানার চেষ্টা করছে।’ বেলা ১১টার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনের ডকইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় পুড়ে যাওয়া ট্রেনটি। তখন পোড়া বগি থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে আসেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা। এ সময় তাদের সঙ্গে সাংবাদিকরাও ডকইয়ার্ডে প্রবেশ করার সুযোগ পান। ভিতরে দেখা যায়, পোড়া বগিগুলোর সবুজ রং কালচে হয়ে গেছে। বগির ভিতরের চিত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এলাকার মতো। সরঞ্জাম রাখার রেলিং খুলে পড়েছে আসনের ওপর। মেঝেতে পড়ে আছে যাত্রীদের সঙ্গে আনা চাল-ডাল। একটি বগিতে আগুনে পুড়ে সিদ্ধ হওয়া লাউ দেখা গেল। বগিটির দরজার কাছে পড়ে আছে একটি স্কুলব্যাগ ও কয়েকটি বইখাতা। পুড়ে কালচে হওয়া ‘ঝ’ বগির মাঝে স্কুলব্যাগটিই কেবল রঙিন। এর বাইরের অংশে কার্টুন চরিত্রের ছবি। পাশে পড়ে থাকা ‘একের ভেতর সব’ লেখা বইটি দেখে মনে হয় ব্যাগটি কোনো শিশুর হাতে ছিল। নিশ্চয় আগুন লাগার সময় হুড়োহুড়ির মধ্যে ব্যাগের মালিক মায়ের হাত ধরে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে গেছে। তখন ব্যাগটি হয়তো তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। জানা গেছে, নিহত নাদিরার স্বামী কারওয়ান বাজারের একজন হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। ঘটনার সময় নাদিরা আক্তারের ভাই এবং তার আরও এক ছেলে ট্রেনে ছিল। তারা ট্রেন থেকে নামতে পারলেও নাদিরা তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে নিয়ে নামতে পারেননি। বকুল আক্তার নামে এক যাত্রী জানান, আগুনের কারণে তিনি তাড়াহুড়ো করে ট্রেন থেকে নেমে আসেন। ট্রেনে তার সঙ্গে ছেলে খোকন ও নাতনি শারমিন (২) ছিল। তিনি ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ট্রেনে থাকা নুরুল হক ওরফে আবদুল কাদের নামে এক যাত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার ধারণা, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে রেলের পোশাক পরা ব্যক্তিরাই আগুন দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের আগে তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে বগির মধ্যে ঘোরাফেরা করছিলেন আর বিভিন্ন কথাবার্তা বলছিলেন। তিনি আগুন দেখতে পেয়ে নাখালপাড়ায় ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন। নুরুল হকের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। তেজগাঁওয়ে থাকেন। তিনি হা-মীম গ্রুপের পরিবহন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেট্রল ব্যবহার না করলে এত দ্রুত আগুন ছড়ানো সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে ময়মনসিংহের গফরগাঁও, বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশনের ২৫০ মিটার পর্যন্ত ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো এখন বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ঢাকা রেলপুলিশের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, ট্রেনের দুই কোচের মাঝের স্থানে প্রথমে আগুন দেখতে পান রেলকর্মীরা। ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানো হয়। তবে তখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং পাশের কোচগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা দ্রুত নামার চেষ্টা করেন। তবে যাত্রীদের কেউ কেউ বিষয়টি বুঝতেই পারেননি। তাদের কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে নাশকতা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন যাত্রীদের বরাত দিয়ে জানান, ট্রেনটি নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসছিল। বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর যাত্রীরা পেছনের বগিতে আগুন দেখতে পান। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। প্রসঙ্গত, দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে ফেলায় গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশনের কাছে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেলপথে ১৩ ডিসেম্বর ভোর সোয়া ৪টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রওহা গ্রামের আসলাম হোসেন (৩৫) নিহত হন। ট্রেনের লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টারসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।

তদন্ত কমিটি : মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে নাশকতার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলের ডিভিশনাল ট্রাফিক অফিসার খায়রুল ইসলামকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি সাংবাদিকদের অবহিত করেন।

 

সর্বশেষ খবর