বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বারবার ট্রেন কেন টার্গেটে

জিন্নাতুন নূর

অবরোধ-হরতালের মধ্যে নিরাপদে যাতায়াতের জন্য রেল মানুষের কাছে আস্থার বাহন। কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৫১ দিনে পাঁচটি ঘটনায় রেলের সাতটি কোচ পুড়ে গেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচজন আর আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ফলে নিরাপদের এই বাহন আর নিরাপদে নেই। ট্রেনে একের পর এক নাশকতায় যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলে জানমালের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি কোচে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখতে হবে। রেলের এটেনডেন্টদের আগুন নেভাতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেই সঙ্গে বগিতে নজরদারির জন্য সিসি টিভি ক্যামেরাও লাগাতে হবে। রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা সারাদেশে ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেন। তিনি জানান, ট্রেনে নাশকতা ঠেকাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য নিয়োজিত করা হবে। আর রেল নিরাপদ রাখতে লাইন চেক করার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলওয়ে দেশের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম যার নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আছে। স্টেশনগুলোর নজরদারি করার জন্য রেলের নিজস্ব পুলিশ বাহিনীও আছে। এরপরও রেলে একের পর এক পরিকল্পিত নাকশতার হামলা হচ্ছে। ২০১৩-১৪ সালেও নির্বাচনের আগে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ট্রেনে নাশকতা সবসময়ই বেশি হয়। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে রেলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রেল কর্তৃপক্ষ কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সেটিও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। যেহেতু সামনেই জাতীয় নির্বাচন এবং দেশে এক রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে এর প্রস্তুতি হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষ কেমন উদ্যোগ নিয়েছে তার তদন্ত হওয়া উচিৎ। রেল কর্তৃপক্ষকে শুধুমাত্র কোচের ভেতর সিট ও খাওয়া নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। হরতাল-অবরোধে রেল ছাড়লে কর্তৃপক্ষের কিছুটা প্রস্তুতি অবশ্যই থাকতে হবে। গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে দাঁড়ানো অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়। এতে ওই ট্রেনের দুটি কোচ পুড়ে যায়। একটি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২য় সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৯ নভেম্বর। জামালপুরের সরিষাবাড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকা ৭৪৫ নম্বর ট্রেন ‘যমুনা এক্সপ্রেসে’ আগুন দেওয়া হয়। সে ঘটনায় দুটি কোচ পুড়ে যায়। এরপর ২২ নভেম্বর সিলেটে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন উপবন এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়। সে ঘটনায় আরেকটি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ২০ ফুট রেল ট্রাক কেটে ফেলা হয়। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি ছিটকে যায়। এতে একজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হোন। একইদিন নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ৭০টি ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এলাকাবাসীর কাছে ধরা পড়লে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর (গতকাল) তেজগাঁও রেলস্টেশনে চলন্ত ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে শিশুসহ চারজন নিহত হয়। তিনটি কোচ একেবারে পুড়ে যায়। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, দুষ্কৃতকারীরা গান পাউডার নিয়ে যাত্রী বেশে ট্রেনে উঠেছিল। পরে সুযোগ বুঝে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ট্রেনের নিরাপত্তায় প্রতিটি বগিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি প্রতি বগিতে একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা হয় তাহলে আগুন লাগলেও তা দ্রুত নেভানো সম্ভব। রেল কর্তৃপক্ষ রেলের অবকাঠামো নিয়ে যত ব্যস্ত এর জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ায় তত মনোযোগী নয়। প্রতি বগিতে যেহেতু একজন এটেনডেন্ট থাকে এ জন্য ট্রেনে আগুন লাগলে করণীয় বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। যেহেতু আমরা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো দেখে আসছি সে হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি থাকা উচিৎ ছিল। রাতে যে আন্তঃনগর ট্রেনগুলো যাতায়াত করে সেখানে কারা ট্রেনে উঠছে আর নামছে এটি এটেনডেন্টের নজরদারি করা উচিৎ। যাত্রীদের চলমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ট্রেনে চলাচলের ক্ষেত্রে নিজেদেরও সজাগ থাকতে হবে। একইসঙ্গে রেলের কোচগুলোর ভেতরেও যথাযথ নজরদারির জন্য সিসি টিভি ক্যামেরা বসানো উচিৎ। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, ট্রেনে আগুন, পেট্রল বোমা নিক্ষেপ, রেললাইন কাটা ও ফিশপ্লেট খুলে ফেলার ঘটনায় এরই মধ্যে অনেকগুলো মামলা হয়েছে। দেড় মাসে কেবল ঢাকাতেই মামলা হয়েছে ১৫টি। আটক হয়েছে ৭০ জন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা রোধে রাত্রিকালীন ট্রেনগুলোর গতি কমানো, যেসব রুটে অনেক রাতে একটি বা দুটি ট্রেন চলে কিন্তু যাত্রী কম হয় সেগুলো বন্ধ রাখার চিন্তা চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো স্থানে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে এমন আগাম তথ্যের ভিত্তিতে আমরা পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে রেললাইন পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। যে ট্রেনগুলো অনেকক্ষণ পর চলবে সেগুলো গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে সেই এলাকা পাহারার ব্যবস্থা করছি। আমাদের ওয়েম্যান নামে একটি পদ আছে, যারা সারা দেশের রেললাইনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরা সারারাত একটি দলে বিভক্ত হয়ে রেললাইন প্যাট্রোলিং করে। সরকার রেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে ২ হাজার ৭০০ আনসার দিচ্ছে। প্রতি কোচে একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৩৩টি স্থাপনায় সিসি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি হচ্ছে। রাতে যেখানে ট্রেন থাকে সেখানেও ক্যামেরা লাগানোর চেষ্টা চলছে।

 

 

সর্বশেষ খবর