বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এক মন্ত্রীর বিদেশে বিনিয়োগ ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা

বিশেষ প্রতিনিধি

এক মন্ত্রীর বিদেশে বিনিয়োগ ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা

সরকারের একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য আছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি। এই মন্ত্রী আসন্ন নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছেন। মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় এ তথ্যের কথা জানাননি। মন্ত্রীর নাম প্রকাশ না করা হলেও এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকার কথা জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, টিআইবি নীতিমালায় না থাকায় নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে সরকারের যে কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে চাইলে তারা এ বিষয়ে সব তথ্য সরবরাহ করবে।

টিআইবি ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘নির্বাচনি হলফনামায় তথ্যচিত্র, জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির গবেষকরা। পরে টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁদের কাছে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে। ওই মন্ত্রী তাঁর হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি। ওই মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে। সেগুলোর মূল্য ১৬ দশমিক ৬৪ কোটি পাউন্ড বা ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ওই মন্ত্রী ২০১০ সালে প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ১ দশমিক ৭৩ কোটি পাউন্ড। এরপর ২০১৬ সালে আরেকটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ৭ দশমিক ৩১ কোটি পাউন্ড। ২০১৯ সালে তৃতীয় কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য দশমিক ৭৯ কোটি পাউন্ড। তিনি ২০২০ সালে চতুর্থ কোম্পানি চালু করেন, যার সম্পদ মূল্য ২ দশমিক ১৫ কোটি পাউন্ড এবং ২০২১ সালে পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি খোলেন, যেগুলোর বর্তমান সম্পদ মূল্য ৩ দশমিক ২২ কোটি পাউন্ড। মন্ত্রীর নাম জানতে চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু তথ্য গোপনের ব্যাপার রয়েছে এবং তিনি নিজে তা প্রকাশ করেননি। সে কারণে তাঁর নাম প্রকাশ করা টিআইবির এখতিয়ারবহির্ভূত। তবে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ যদি টিআইবির কাছে তথ্যসূত্র জানতে চায়, তাহলে তাঁরা তথ্যপ্রমাণসহ তা দেবেন।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির গবেষকরা হলফনামা বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানানো হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ১০০ কোটির বেশি সম্পদ রয়েছে ১৮ জনের বেশি প্রার্থীর। স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ৪৮০ জন। প্রতিবছর আয় ১ কোটি টাকার বেশি ১৬৪ প্রার্থীর। গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করে তথ্যচিত্র তুলে ধরেন তিন সদস্যের গবেষণা দলের প্রধান তৌহিদুল ইসলাম। অন্য দুই সদস্য হলেন- রিফাত রহমান ও রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া আয়-সম্পদ ও ঋণ-দায় বিবরণী কতটা সঠিক এবং আয় ও সম্পদ কতটা বৈধ উপায়ে অর্জিত তা যাচাই করা হয় না। আবার সম্পদের অর্জনকালীন যে মূল্য হলফনামায় দেখানো হয়েছে তা নিয়েও বড় রকমের প্রশ্ন রয়েছে। হলফনামায় প্রার্থীরা নিজেদের অর্জিত সম্পদ কতটা দেখিয়েছেন? পুরোটা দেখিয়েছে কি না? কিংবা দেশে বা বিদেশে সম্পদ ধারণের তথ্য গোপন করেছেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

শত কোটি কোটি টাকার মালিক শীর্ষ ২০ প্রার্থী : নির্বাচনি হলফনামায় ১০০ কোটি টাকা বেশি আছে এমন প্রার্থীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামানের সম্পদ ৪২১ কোটি টাকা। সালমান এফ রহমানের সম্পদ ৩১৫ কোটি টাকা। কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিনের সম্পদ ৩০৬ কোটি, কুমিল্লা-৩ আসনের এমপি আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের ২৭৭ কোটি, চুয়াডাঙ্গা-১ স্বতন্ত্র প্রার্থী দিলীপ কুমার আগরওয়ালার ২৭৬ কোটি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আবদুল মমিন মন্ডলের ২৫৩ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জ-১ স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী গোলাম মুর্তজার ২৩৩ কোটি, নংসিংদী-৩ স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ১৭৪ কোটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও ঢাকা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাঈদ খোকনের ১৬৩ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। 

আয়ের শীর্ষে ১০ মন্ত্রী : গত পাঁচ বছরের আয়ের শীর্ষে রয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তার আয় হয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার আয় বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের আয় বেড়েছে ২২৮ শতাংশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের আয় বেড়েছে ২২৭ শতাংশ, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের আয় বেড়েছে ১৬৪ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের আয় বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর আয় বেড়েছে ১২২ শতাংশ এবং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আয় বেড়েছে ৯১ শতাংশ।

কোন দলে কত কোটিপতি : নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের মূল পেশা ব্যবসা। আর বাৎসরিক আয় ১ কোটি টাকার বেশি এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৬৪ জন। ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৮ জন। স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ৪৮০ জন। এ ছাড়াও ১০ কোটি টাকার বেশি আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। ১ কোটি টাকাও নেই এমন প্রার্থী ৭২ দশমিক ০৯ শতাংশ। কোটিপতি প্রার্থীর মধ্যে ২৩৫ জন আওয়ামী লীগের, ১৬৩ জন স্বতন্ত্র, ৪৭ জন জাপা, ১৭ জন জেপি, ৭ জন জাসদ, ৬ জন তৃণমূল বিএনপি, ৫ জন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির।

স্বতন্ত্র প্রার্থী বেড়েছে : দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধীশক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন করছেন। গত চারটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখেছে, এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৪৭ প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন। এর আগে যথাক্রমে ২০১৮ সালে ১৩৪ জন, ২০১৪ সালে ১০৫ এবং ২০০৮ সালে ১৪০ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।

স্বশিক্ষিত প্রার্থী ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ : নির্বাচনি হলফনামা অনুযায়ী, দ্বাদশ নির্বাচনে মোট প্রার্থীর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রার্থীর ফরমাল কোনো শিক্ষার সনদ নেই অর্থাৎ তারা স্বশিক্ষিত প্রার্থী। এরপর ৫৭ শতাংশ প্রার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী স্নাতক। এই অংশ ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্নাতকোত্তর। এ স্তরের প্রার্থীর সংখ্যা ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন ১১ শতাংশ, মাধ্যমিক ৯ শতাংশ প্রার্থী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর